গণমাধ্যমে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোন অনুষ্ঠানের ছবি দেখানো হয় বা পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়, তখন সবচেয়ে আগে দেখি আজ প্রধানমন্ত্রী কী শাড়ি পরেছেন? অধিকাংশ সময়েই উনি অপূর্ব সুন্দর সব জামদানি শাড়ি পরেন, যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, মন ভরে উঠে। কি সুন্দর রং, কি ডিজাইন আমাদের তাঁতিদের হাতে তৈরি শাড়ি। গর্বে বুকটা ভরে যায়। বাংলাদেশ জামদানি শাড়ির দেশ বা বলা যায় জামদানি শাড়ি বাংলাদেশের শাড়ি। এদেশের প্রধানমন্ত্রী যে তাঁর পোষাকের তালিকায় জামদানি শাড়িকে অগ্রাধিকার দেবেন, সেটাইতো স্বাভাবিক। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী ঠিক সেটাই করছেন। উনি জামদানি শাড়িকে বিশ্বের সামনে দারুণভাবে তুলে ধরেছেন।
এই শাড়ির উপর যে বাংলাদেশের অধিকার শতকরা ১০০ ভাগ, এই শাড়ির পুরো পেটেন্টই যে আসলে আমাদের, তা নতুন করে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যদি আমরা জামদানি শাড়ির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বলি, তাহলে কি তা ভুল কিছু বলা হবে? উনি সংসদে, মন্ত্রী পরিষদের মিটিং-এ, রাষ্ট্রীয় বা অন্য অনুষ্ঠানে, রাজনৈতিক জনসভায়, বিদেশী অতিথিদের সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারতপক্ষে জামদানি ছাড়া অন্য শাড়ি কমই পরেন। কখনও কখনও উনি অনুষ্ঠানের বা দিবসের থিমের সাথে ম্যাচিং করে জামদানি পরেন। যেমন স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছি লাল-সবুজের শাড়ি পরতে, একুশে পরেন সাদা-কালো, নারী দিবসে পরেন বেগুনি জামদানি। তাতেই বোঝা যায় উনি মন থেকে জামদানিকে গ্রহণ করেছেন এবং এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছেন বহুগুণ।
প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানে তাই যেসব নারী অতিথি যান তারা পারতপক্ষে জামদানি পরারই চেষ্টা করেন। কারণ সবাই ইতোমধ্যে বুঝে গিয়েছেন ঐসব ঝাকানাকা শাড়ির বা জর্জেট-শিফন শাড়ির বদলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জামদানিই ভালবাসেন পরতে এবং দেখতে। প্রধানমন্ত্রীর পরনের জামদানি শাড়িগুলো একবার দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। বিদেশীরা পর্যন্ত চোখ ফেরাতে পারেন না।
আর তাইতো ভারতের রাষ্ট্রপতির স্ত্রী, সোনিয়া গান্ধী সবাইকে উপহার হিসেবে জামদানি শাড়ি দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকবার। রাহুল গান্ধী যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন উনি তার মা বোনের জন্য অনেকগুলো জামদানি শাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন বলে পত্রিকায় দেখেছি। ভারত শাড়ির স্বর্গভূমি। ওখানে যতগুলো রাজ্য আছে, সব রাজ্যে আলাদা আলাদা শাড়ি আছে। প্রতিটি শাড়ির বৈশিষ্ট্যও আলাদা এবং অনন্য। কিন্তু এই ভারতীয় নারীদেরও দেখেছি বাংলাদেশের জামদানি বলতে অজ্ঞান। ভারতীয়রা যখন ঢাকায় আসেন, তখন এখানে আর কিছু তারা কিনুক, আর নাই কিনুক, জামদানি শাড়ি ও জামার কাপড় কিনবেনই। একজন ভারতীয় নারী সাংবাদিক বলেছিলেন, ‘ঢাকাই জামদানি আর আমাদের জামদানিতে অনেক তফাৎ। ঢাকাই জামদানির ডিজাইনই আলাদা। আমি যখন সেরকম কোন অনুষ্ঠানে যাই, তখন সবসময় ঢাকা থেকে কেনা ঢাকাই জামদানি পরি। অন্যরা খুব জেলাস বোধ করে । হা হা হা।’
কেরালার এলিজাবেথকে আমি বোন বলি। কারণ আমার খুব দু:সময়ে দিল্লীতে ও আমার পাশে ছিল। ওর খুব পছন্দের এই জামদানি শাড়ি। ও নাকি জামদানি শাড়ি দেখলে চোখ ফেরাতে পারে না। আমাদের দেশে নিযুক্ত মার্কিন অ্যাম্বাসেডর অনেক অনুষ্ঠানেই সুন্দর সুন্দর জামদানি পরেন দেখেছি। জামদানি যে এদেশের ঐতিহ্য এটা বুঝতে এখন আর কারও বাকি নেই। উচ্চবিত্ত ফ্যাশন সচেতন নারীদের মধ্যেও এখন জামদানির খুব কদর দেখা যায়।
মসলিনের পঞ্চম সংস্করণ এই জামদানি কিন্তু মুঘল সম্রাটদের আমল থেকে সমাজে প্রচলিত। জামদানি পারসিয়ান শব্দ। জাম মানে ফুল আর দানি মানে ফুল রাখার পাত্র। জামদানির জমিনে করা ফুলেল ডিজাইনের জন্য হয়তো এমনটা নাম হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইন্টালেকচ্যুয়াল প্রপার্টি আইন, এতে ভারতের দাদাগিরি, জামদানির স্বত্ত্ব নিয়ে টানাটানি, যাই হোক না কেন জামদানি মানে আমরা বুঝি, বিশ্ব বোঝে এমনকী খোদ ভারতও বুঝে— ঢাকাই জামদানি। জামদানি তৈরি হয় বাংলাদেশের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায়, নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে, নিজস্ব বুনন রীতিতে, ঐতিহ্য মেনে। এই তাঁতিরা বাংলারই। কাজেই এই জামদানির উপর অন্য কেউ হাত রাখলেও, এর জন্ম বলে, এর বুনন বলে এটা বাংলার শাড়ি, আর বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ।
আমরা যারা জামদানি শাড়ি পরি ও পরতে ভালবাসি, তারা সবসময়ই চেয়েছি দেশে এই শাড়ির বাজার তৈরি হোক। তাঁতিরা ভাল থাকুক। প্রকৃতপক্ষে শাড়ির বাজারতো খুব ছোট। তাই আমাদেরই এই বাজার তৈরি করতে হবে। আমরা বিয়েতে বউকে দামী ও ঘন কাজ করা জরি জামদানি পরাতে পারি। লাখ টাকা দামের লেহেঙ্গা বা জরি-চুমকি ঠাসা উদ্ভট ডিজাইনের জর্জেট এর শাড়ির বদলে জামদানি কি কম উজ্জ্বল হবে? নিজেদের ঐতিহ্য বাঁচাতে এই বিষয়টি আমরা ভেবে দেখতে পারি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এই বাজার তৈরির দায়িত্বটি মাথায় তুলে নিয়েছেন। বাংলাদেশের যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনি যদি জামদানি ও তাঁতের সুতি শাড়ি বাদ দিয়ে বিদেশী শিফন, জর্জেট, সিল্ক ও জমকালো কাজ করা ঝাকানাকা শাড়িগুলো পরতেন, তাহলে কি ভাল হতো নাকি উচিৎ হতো, নাকি তা আমাদের গর্বিত করতো? বাংলাদেশের যিনি নেত্রী, তিনিতো বাংলার ঐতিহ্যকেই ধারণ করছেন, এর চেয়ে সুখের আর কি হতে পারে? যতটুকু মনে পড়ছে, উনি যখন দেশে এলেন, যখন রাজনীতি শুরু করলেন, যখন রাজপথে থাকতেন, যখন বিরোধী দলীয় নেত্রী ছিলেন, তখনও শেখ হাসিনা তাঁতের সুতির শাড়ি ও হালকা কাজের জামদানিই পরতেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)