চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

শুধু রক্ত নয়, বাজেটও খেয়ে ফেলছে মশা

অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না। এবারের ডেঙ্গুকে মহামারী ঘোষণা দিতে জড়তা থাকলেও জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করতে লজ্জা কোথায়? এত বছর ঢাকার মানুষ ভুগলেও এবার দেশের ৬৩ জেলার মানুষ ভুগছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে- প্রতি মিনিটে নতুন করে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তিন থেকে চারজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। ঢাকার কোন হাসপাতালে আসন নেই। আক্রান্ত মানুষকে নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বজনরা ছুটছেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। এখনই তো সময় জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করে সমন্বিতভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ার। তা আর হওয়ার জো কোথায়? মেয়র, মন্ত্রী পাইক পেয়াদা সব মিলে মিশে রশি টানাটানিতে মেতেছেন। মশার ওষুধ তো আগেরগুলো খাওয়া শেষ, নতুন ওষুধ কে কোথায় কিভাবে কবে আনবেন তা নিয়ে চলছে উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে ঠেলে দেয়ার খেলা। ঢাকাবাসীর চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্যি যে মহামান্য হাইকোর্ট ছিলেন। তা না হলে এই ঠেলাঠেলি তো গুঁতোগুতিতে গড়াতো তা নিশ্চিত।

ঢাকার মানুষরা আসলেই দুর্ভাগা। তাদের নাকি! দুই দু’জন অভিভাবক তথা নগরীর পিতা রয়েছেন। তারা কতটা জনবিচ্ছিন্ন একটু মাঠে ঘাটে হাঁটুন। মানুষের সাথে কথা বলুন। দেখুন তারা কি বলে! মেয়র তো বহু দূর ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে যে নারী-পুরুষ কাউন্সিলররা আছেন, তাদের কাজ কি? বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি ঢাকার দেড় কোটি বাসিন্দার এক কোটিই এই মুহুর্তে তার নিজের এলাকার কমিশনার বা কাউন্সিলরকে চেনা তো দূরের কথা, তাদের নামও বলতে পারবেন না ঠিকমতো। অথচ এলাকার মানুষের সুখে-দুঃখে তাদেরই তো সবার আগে পাশে দাঁড়ানোর কথা। ভয়াবহ রকমের এক জনবিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতি যে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এটির সামাজিক ব্যখ্যা নিশ্চয়ই সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা দিতে পারবেন।

তবে এই জনবিচ্ছিন্নতার ফল হচ্ছে ভয়াবহ। ভবিষ্যত আরও অন্ধকার। একজন পজিটিভ থিংকার হয়েও নিজেও ঢাকাবাসীর ভবিষ্যত অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। এই যে মানুষ মারাত্মক রকমের আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন, ওয়ার্ডের মুরুব্বিদের কেউ কোথাও দেখেছেন দল-বল নিয়ে এডিস মশা ধ্বংস করতে মাঠে নেমেছেন? নিদেন পক্ষে প্রচার প্রচারণায় মানুষকে সচেতন করছেন। তাদের টিকিটিও কেউ পায়নি, পায়না। শুধু ভোটের আগে দু’চারটে পোস্টারে দাঁত ক্যালানো হাসির ছবি আর খুব জরুরি দরকারে নাগরিকত্ব সনদের জন্য কাঠখড় পুড়িয়ে ওই উঁচুতলার মানুষগুলোর দেখা মেলে। আর মেয়রদ্বয়- সে তো দেবতূল্য। উত্তরের ভদ্রলোক নতুন। তিনি হয়তো এখনো অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। কিন্তু দক্ষিণের দেবদূত এ পর্যন্ত মানুষের যত অভিশাপ আর বদনাম কুড়িয়েছেন- তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকেই তাকে যোগ্য পিতার অযোগ্য উত্তরসূরি বলছে- জানি না এটা কতটুকু সত্য। তবে দক্ষিণের কমিশন বাণিজ্য, বাজেট হাপিস নিয়ে রমরমা আলোচনা আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই হয়তো শেষ পর্যন্ত এদিকে নজর দিতে হবে।

ঢাকার মানুষরা দুর্ভাগা অনেক কারণে। বাতাসে বিষ। খাবারে ভেজাল। পানিতে ভেজাল। ব্যয়বহুল তো বটেই। মধ্যবিত্তের তো ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সমাজে আয় ও সম্পদের বৈষম্য ভয়াবহ রকমের বেড়ে যাওয়ায় একটা অস্থির সময়ের দিকে ধাবিত হচ্ছি আমরা। ঢাকার মধ্যবিত্তরা না পারেন সইতে না পারেন কইতে। চড়া বাসা ভাড়া, অনিশ্চিত যাতায়াত ভাড়া, চিকিৎসা, খাবার খরচ মিলিয়ে মাসের শেষে ধার-কর্জ করে চলা মানুষগুলো এই দুর্যোগে যে কি পরিমাণ ভোগান্তি আর মানসিক চাপে পড়েছেন তা বোঝার ক্ষমতা ক্ষমতাবানদের নেই। পরিচিত যত মানুষের স্বজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে, তাদের অমানবিক ছোটাছুটি আর অসহায়ত্ব দেখলেই বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। একেকজন আক্রান্তকে সুস্থ্য করতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর গলাকাটা অযাচিত বিল পরিশোধ করতে করতে মানুষগুলো অসহায় হয়ে যাচ্ছে। জমানো সর্বস্ব খুইয়ে ঋণগ্রস্থ হয়ে যাচ্ছে ঢাকার হাজারো মানুষ।

ডেঙ্গু জ্বর আতঙ্কসরকারি হাসপাতালগুলোতে সদ্য ডেঙ্গুর বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা চালুর কথা বলা হলেও সেখানেও ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা। ভোগান্তির কথা আর না ই বা বলাম। তার পরেও তো মৃত্যুর সংখ্যা কমছে না। উপসচিবের স্ত্রী, চিকিৎসক, পুলিশ, শিশু, নারী, শিক্ষার্থী- ঝরে যাচ্ছে একের পর এক তাজা প্রাণ। আপনারা সংখ্যায় গুনে গুনে ১৪ জন বের করেছেন, যদিও এ তালিকায় মানুষের তেমন বিশ্বাস নেই। তবুও আপনাদের হিসেবে ১৪ জনের পরিবারের ভবিষ্যৎটা একবার ভেবে দেখেছেন?

এই পরিস্থিতির জন্য দায়ি কে? আপনারা নাগরিকের ঘাড়ে বর্তে দিয়েই পগার পার হওয়ার চেষ্টা করছেন। বলছেন বাসা বাড়ির মশা মারার দায়িত্ব নাগরিকদের। তাহলে আপনাদের দায়িত্বটা কি? ফি বছর মশা মারার বাজেট বাড়িয়ে লুটে পুটে খাওয়া? মানুষকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে, কিন্তু মূল দায়িত্বটা তো আপনাদের। আপনারা তো শপথ নিয়েছেন নগরবাসীর সেবা দেয়ার জন্য। দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা যতটুকু বলে, আপনারা অন্তত কিছু খাত থেকে দুনীতি আর কমিশন দয়া করে ছেড়ে দেন। কিছু ক্ষেত্রে কঠোর হোন। দেখবেন মানুষ যুগ যুগ আপনাদের মনে রাখবে। কারণ মশার ওষুধ নিয়ে দুর্নীতির খবর নতুন নয়। সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত মামলাও করেছিল ওয়ান ইলেভেন সরকার। তার আগেও নয়-ছয় হয়েছে। এখন আরও বেশি হয়। অলিখিত কমিশন ছাড়া কোন কেনাকাটা হয়না এই ধারণা থেকে মানুষকে সরাতে আপনাদের স্বচ্ছতা দরকার।

জবাবদিহিতার জায়গাটা আরও পরিষ্কার করতে হবে। কারণ মানুষ আপনাদের শুকনো কথায় বিশ্বাস করে না এটা আপনারাও ভাল করে জানেন। আর কথা বলার ছিরিও তো ভাল নয় আপনাদের, মানুষ যেখানে স্বজনদের নিয়ে ছুটোছুটি করছে সেই সময় আপনারা নাগরিকদের নিয়ে রসিকতা করছেন। সেই রসিকতা করার জন্য পরবর্তীতে সাধারণ একটি ক্ষমা চাওয়ার ভদ্রতাও অনেক ক্ষেত্রে আশা করে নগরবাসী। সেই আশাতেও আপনারা গুড়ে বালি দিয়েছেন।
চিকিৎসক আর নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা সেই জানুয়ারি থেকে আপনাদের বার বার সতর্ক করলেও আপনারা কুম্ভকর্ণ হয়ে বসে ছিলেন। ঘুম যখন ভাঙলো- দেখলেন নিজের কাথাটিও পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। এখন আর পেছনে ফেরার সময় নেই।

মাননীয় মেয়রদ্বয় আপনারা মশা মারার দায় নাগরিকদের ঘাড়ে চাপিয়েছেন ভাল কথা, কিন্তু নিজেরা তো এই খাতের বাজেট গত পাঁচ বছরে ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে নিয়েছেন। তো কি করেছেন সেই টাকা? একজন নাগরিক আপনাকে সেই প্রশ্ন করার সাংবিধানিক এখতিয়ার রাখে। আপনারা অকার্যকর ওষুধ কিনেছেন। নয়-ছয় করেছেন। মশার ওষুধে পানি মেশানোর ঘটনাও তো নতুন নয়। আপনাদের তো উচিত ছিল নগরবাসীর কথা ভেবে বছরজুড়েই সতর্ক থাকা। মানুষকে সম্পৃক্ত করা। কিছুই করেননি। এমনকি ঢাকার বহু স্থান আছে, বাসিন্দাদের জিজ্ঞেস করুন কতদিন পর পর মশার ওষুধ ছিটানো হয়, বলতেও পারবে না। আপনাদের কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নেই, মনিটরিং নেই তদুপরি মারাত্মক রকমের সমন্বয়হীনতার খেসারত কেন এভাবে দেবে নগরবাসী?

আপনাদের বাজেটের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিন। রাজধানীতে মশক নিধনের জন্য ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাজেট ছিল ২১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এর জন্য দুই সিটিতে অর্ধশত কোটি টাকা খরচ করা হয়। এ খাতে গত পাঁচ বছরে দুই সিটি করপোরেশনের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বরাদ্দ বেড়েছে ১৩৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বরাদ্দ বেড়েছে ১২২ দশমিক ২২ শতাংশ। চলতি অর্থবছর তো আপনারা বাজেট ঘোষণাই করতে পারেননি। এ বছর নিশ্চই আরও বাড়বে।

দুই সিটি করপোরেশনে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) মশা নিধনে বরাদ্দ ছিল ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সামান্য কমে দক্ষিণ সিটিতে বরাদ্দ ছিল ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, উত্তর সিটিতে ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। পরের বছর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে দক্ষিণ সিটিতে বরাদ্দ হয় ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা, উত্তর সিটিতে ২০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মশক নিধন খাতে ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশন করেছে ২১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকার মশার ওষুধ কিনেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। অন্যদিকে ডিএনসিসিতে গত অর্থবছরে ১৮ কোটি টাকার ওষুধ কিনেছে।

এগুলো কাগুজে পরিসংখ্যান। বিশ্বাস করুন, মানুষ এসব পরিসংখ্যান দেখতে চায় না। আপনারা কে কত লুটে খেলেন তা নিয়েও মানুষের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। মানুষ শুধু চায় পরিবার পরিজন নিয়ে শান্তিতে একটু ঘুমাতে। দু’বেলা ভাল মন্দ খেয়ে বাঁচতে। মানুষের সেদিকটা নিশ্চিত করুন। আপনাদের হিসেব নিয়ে কেউ কোনদিন টান দেবেনা। এসব দেখার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। দায়িত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। দায়িত্ব দুদকের। আর মহামান্য হাইকোর্ট তো মানুষের বিপদেই পাশে দাঁড়াবে। মশার ওষুধ নিয়ে আর নয়-ছয় নয়, কোন টালবাহানা নয়। দ্রুত আনুন। মানুষ বাঁচান। দুর্যোগ ঘোষণা করে সবাই হাতে হাত মিলিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করুন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে না থাকলে হয়তো আপনাদের এতটা লেজেগোবরে অবস্থা হত না। সব কিছুতেইতো তার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়। নিশ্চয়ই তিনি দেশে আসার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে আপনাদের মশা মারার বাজেটের দিকে একটু নজর দেবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় ঢাকার দুই সিটির গত তিন চার বছরের মশা মারার বাজেটের দিকে দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটু শক্তভাবে নামিয়ে দিন। দেখবেন ঠিকই কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে এসেছে। যে কালসাপ আপনি দুধকলা দিয়ে পুষে এসেছেন। কারণ ঢাকার মশারা শুধু রক্ত খায়না, ওরা বাজেট খেতেও পটু।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)