খেলার সাথীকে ধর্ষণের অভিযোগে চার শিশুকে গ্রেপ্তারের পর তাদের বিরুদ্ধে করা ধর্ষণের মামলাটি অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দৃষ্টান্ত মূলক রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
চার শিশুর বিরুদ্ধে ফৌজদারী ব্যবস্থা গ্রহণের বৈধতা প্রশ্নে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে রোববার বিচারপতি মো.মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্লার ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালত তার রায়ে ওই চার শিশুর ক্ষেত্রে এখতিয়ার বহির্ভূত আদেশ দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট বিচারকের ফৌজদারী বিচারিক এখতিয়ার পরিবর্তন করে তাকে দেওয়ানি বিচারিক এখতিয়ারে যুক্ত করতে আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। আর আইন অমান্য করে শিশুদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী ব্যবস্থা (ধর্ষণের মামলা দেওয়া) গ্রহণ করায় বাকেরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি),দুই উপপরিদর্শক (এসআই) ও শিশুদের গ্রেপ্তারের সাথে যুক্ত চার পুলিশ সদস্যসহ মোট সাত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের প্রতি এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া আইন অনুযায়ী যথাযথ দায়িত্ব পালন না করায় বরিশালের প্রবেশন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সমাজসেবা অধিপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে রায়ের নির্দেশ বাস্তবায়নে আদালতের সিদ্ধান্তের বিষয়টি চলমান (কন্টিনিউয়াস মেন্ডামাস) রাখা হয়েছে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ রাসেল চৌধুরী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল গোলাম সারোয়ার পায়েল। আর শিশু অধিকার সংগঠন চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ও আইনি সহায়তাকারী সংগঠন ব্লাস্টের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মো. আব্দুল হালিম। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী জামিউল হক ফয়সাল।
দৃষ্টান্ত মূলক এই রায়ের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে ব্যারিস্টার মো. আব্দুল হালিম বলেন, ”আদালত রায়ে বলেছেন, সংশ্লিষ্ট বিচারক আইন না পড়ে এবং শিশু আদালতের (জেলা জজের)সাথে পরামর্শ না করে অথবা পরামর্শ না নিয়ে যে বিচারিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এটি কেবল তার অধিক্ষেত্রের বাইরেই নয়, বেআইনিও। সে কারণে তিনি এই আদালতে (হাইকোর্টে) যে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তার এই নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে বিচারিক কর্মকর্তারা এ ধরনের এখতিয়ারবহির্ভূত, বেআইনি সিদ্ধান্ত নিতেই থাকবেন। আর পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, শিশু আইনকে অমান্য করে, বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা নীরিহ নিরাপরাধ শিশুদের ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় যেভাবে ব্যবহার করছে, তা কেবল আইনের লঙ্ঘনই নয় একই সঙ্গে তা শিশুদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। ফলে ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ যদি না করা হয় তাহলে তারা ক্রমাগতভাবে শিশুদের লঙ্ঘন করে চলবে। এছাড়া প্রবেশন কর্মকর্তার বিষয়ে আদালত বলেছে, এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে তিনি তার দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা দেখিয়েছেন।’
গত ৬ অক্টোবর বাকেরগঞ্জে ছয় বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে তার বাবা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। সে মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা ভিকটিম শিশুটির খেলার সাথী। ৪ অক্টোবর বিকেলে বাগানে খেলার সময় তাকে তিন আসামির সহযোগিতায় এক আসামি ধর্ষণ করে। আসামিদের একজনের বয়স ১১ ও বাকি তিন জনের বয়স ১০ বছর দেখানো হয় মামলায়। পরবর্তীতে ৭ অক্টোবর বিকেলে ৪ শিশুকে বাকেরগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। এরপর বিচারক চার শিশুকে যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠান।বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ দেখে ৮ অক্টোবর রাতে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত আদেশ দেন। আদালত তার আদেশে যশোরের জেলা প্রশাসককে পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র হতে ওই শিশুদেরকে ওই রাতেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রোবাসে করে অভিভাবকের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এছাড়া ওই চার শিশুকে তাদের অভিভাবকসহ ১১ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১১ টায় হাইকোর্টে উপস্থিত হতে বাকেরগঞ্জের ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সাথে থানার শিশু বিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা, বরিশালের প্রবেশন কর্মকর্তা ও সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে একই দিন হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়। হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী যশোরের পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে ৪ শিশুকে ওই রাতেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রোবাসে করে তাদের অভিভাবকের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এরপর ১১ অক্টোবর ওই চার শিশু ও তাদের অভিভাবককে নিয়ে আদালতে উপস্থিত হন বাকেরগঞ্জের ওসি ও থানার শিশু বিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা। এছাড়া হাইকোর্টে হাজির হন চার শিশুকে যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এনায়েতউল্লাহ ও বরিশালের প্রবেশন কর্মকর্তা। এইদিন খাস কামরায় নিয়ে শিশুদের আর আদালত কক্ষে শিশুদের অভিভাবক, বাকেরগঞ্জের ওসি, শিশু বিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা, বরিশালের প্রবেশন কর্মকর্তা ও সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বক্তব্য শুনেন হাইকোর্ট। শিশুদের বিচারের এখতিয়ার না থাকার পরেও চার শিশুর বিষয়ে আদেশ দেওয়ায় হাইকোর্টের কাছে ওইদিন নিঃশর্ত ক্ষমা চান জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। একপর্যায়ে আদালত শিশুদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের নির্দেশ দেন এবং রুল জারি করেন। এরপর রুল শুনানিতে শিশু অধিকার সংগঠন চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ও আইনি সহায়তাকারী সংগঠন ব্লাস্ট পক্ষভুক্ত হয়। শুনানি শেষে আজ হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন।