চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

শিমু দে: রবীন্দ্রসঙ্গীতেই যার আত্মনিবেদন

রবীন্দ্রসঙ্গীতের যারা অনুরাগী তাদের কাছে এই প্রজন্মের শিল্পী শিমু দে এখন ভীষণ পরিচিত এবং সমাদৃত এক নাম।

সকালে বা রাতে বিভিন্ন চ্যানেলে প্রেম-ভালোবাসা, বিরহের গানের ডালি নিয়ে প্রায়শই হাজির হন তিনি। দরদী সুরে সিক্ত করেন দর্শক শ্রোতাদের মন।

তার মনোমুগ্ধকার পরিবেশনা আর সুরের মূর্চ্ছণায় হ্নদয়ে মধুর প্রশান্তি অনুভূত হয়। অনবদ্য সুরের ছোঁয়ায় সঙ্গীতপিপাসুদের সকাল-রাত্রিকে তিনি বড্ড রোমান্টিকও করে তোলেন। অন্য গানে তিনি সমান পারদর্শী হলেও রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চায় নিজেকে বেশি আত্মনিবেদন করেছেন।

রবীন্দ্র সঙ্গীত ঘিরেই তার স্বপ্ন বিস্তৃত। রবীন্দ্রনাথের গানের সাথেই তার আত্মার প্রেম-ভালোবাসা।

শিল্পী হিসেবে কেমন তিনি? কেনইবা মনোযোগ কেড়েছেন, বিশেষত্ব অর্জন করেছেন? এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গুগলে অনুসন্ধান করি।

ডিজিটাল এই যুগে গুগলে অনুসন্ধান করলে যেন সব প্রশ্নের উত্তর মেলে। ইউটিউব চ্যানেলে অনুসন্ধান অপশনে গিয়ে শিল্পী শিমু দে’র নাম লিখতেই ল্যাপটপ স্ক্রীণে ভেসে আসে তার গাওয়া কিছু গান। চোখ আটকে যায় জনৈক ঝলক তালুকদারের ইউটিউব চ্যানেলে। যেখানে শিমু দে’র গাওয়া ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে তোমারই সুরটি আমার’-এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটি আপলোড করা। গানটি শুনেই মনে হলো-যথার্থ অর্থেই মুগ্ধময় উচ্চারণে বড্ড প্রাণময়। হৃদয় নিসৃত সুর, আবেগ আর উচ্ছ্বাসে ভরা-এ গান যেন দ্রুতই সঙ্গীতপ্রেমীদের ভেতরে টেনে নেওয়ার সক্ষমতা রাখে। রবীন্দ্রনাথের এ গানটি বেশ আগেই গেয়েছিলেন তিনি। ২০১২ সালে লেজার ভিশন থেকে বেরিয়েছিল শিমু’র প্রথম সিডি অ্যালবাম ‘চাই শুনাবারে’। এই গানটি সেই অ্যালবামের।

অনুসন্ধানী চোখ দিয়ে কমেন্টগুলো খেয়াল করলাম। দেখি, অরুণ কুমার ভট্টাচার্য নামে একজন লিখেছেন ‘গলায় সুর আছে, ওজন আছে, উচ্চারণে স্পষ্টতা আছে। রবীন্দ্র সঙ্গীতে এগুলো বিশেষ আবশ্যক। তবেই রস শ্রুতিমধুর হয়। শুভেচ্ছা রইল।’

শিমুকে যিনি এই মন্তব্য করে মূল্যায়ন করেছেন তিনি যে সঙ্গীতানুরাগী সন্দেহ নাই। এই একটি মন্তব্যের মাঝেই শিল্পী শিমু দে’কে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এই গানের কমেন্টে আরও একজন লিখেছেন ‘আউটস্ট্যান্ডিং’। আরেকজন লিখেছেন ‘কিছু বলার নেই, ভাষা হারিয়ে গেছে’। এসব শ্রোতা মতামত। গায়নশৈলীতে শিমু দে যেনো আলাদা। হ্নদয়ভক্তি আর শ্রদ্ধায় গানের বাণীতে তিনি যেন একাকার। যে তাঁর গাওয়া গান শুনবে সেই সুরসাগরে কিছুক্ষণ হলেও ডুবে থাকবে।

রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেই শিমু দে’র বিশেষ পরিচিত। ব্র্যান্ডিংটা সেভাবেই হয়েছে তার। তবে নজরুল সঙ্গীত পরিবেশনেও তিনি বৈশিষ্ঠ্যমন্ডিত। মৌলিক গানেও স্বচেষ্ট। কিন্তু রবীন্দ্রনাতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ এবং উদ্ভাসিত। রবীন্দ্র সঙ্গীতের মাঝেই তাকে বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যায়।

বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে শিমু নিয়মিত গান পরিবেশন করেন। চ্যানেল আই, এনটিভি, আরটিভি, একুশে টিভি, এসএ টিভিসহ প্রায় সব চ্যানেলেই তার কদর। কদর হবারই কথা। সকালে বা রাতের অনুষ্ঠানে সুরব্যাঞ্জনায় তার নিবেদন অতুলনীয়। এই নিবেদনগুলো গুগলে পাওয়া যায়। গুগলে অনুসন্ধান দিলে তার গাওয়া বিচিত্র স্বাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত দ্রুত স্ক্রীনে আসে।

রবীন্দ্রনাথের অজানা-অচেনা গানগুলোতে তার মনোযোগ খানিকটা বেশি। এসব গানে নিজেকে আবিষ্কার করেন অন্যভাবে। যেমন: রবীন্দ্রনাথের ‘ও কেনো চুরি করে যায়’, ‘জানি তোমার নাহি সে’, ‘হায় গো ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায়’,-এরকম অনেক গান আপনার মনকে প্রশান্তময় করে তুলবেই।

একক এবং মিক্সড মিলিয়ে এ পর্যন্ত চারটি সিডি অ্যালবাম বেরিয়েছে শিমুর। এসব সিডির গানগুলো আছে বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে। ইমপ্রেস অডিও ভিশন থেকে ২০১৮ সালে তাঁর গাওয়া দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘সাগর পাড়ের সুর’ বের হয়েছিল। এই অ্যালবামে ছিল পাঁচটি গান- ‘পুরনো সেই দিনের কথা’, ‘আহা আজি এ বসন্তে’, ‘কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া’, ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’, ‘কালী কালী বলোরে আজ’। এই অ্যালবামের সঙ্গীত আয়োজনে ছিলেন ইন্দ্রজিত দে। সঙ্গীত পরিচালনা করেন হিমাদ্রী শেখর।

এই অ্যালবামের ভূমিকা লিখেছিলেন তারই শিক্ষক বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী লিলি ইসলাম। যিনি অ্যালবামের প্রেক্ষাপট এবং শিমু’র আগামী দিনের চলার পথ নিয়ে চমৎকার শব্দচয়নে উৎসাহী কথামালা উপস্থাপন করেছিলেন। শিমুর এই অ্যালবামটির বিশেষত্ব ছিল পাশ্চাত্য সুরের প্রভাবে রচিত গানগুলো সেই ভাষাতেও গাওয়া।

সন্দেহাতীতভাবে এই অ্যালবাম থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের আলাদা এক স্বাদ গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন শ্রোতারা। আর এমন একটি কাজ করে শিমু নিজেও নতুন অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। শিমুর ভাষায়, ‘এরকম কাজ এর আগে হয়নি। যেসব ভাষা থেকে কবিগুরু অনুপ্রাণিত হয়ে গান করেছিলেন, সেগুলো সেই ভাষাতেও গেয়েছিলাম। ফলে শ্রোতারা একই গানের দুই ভাষার স্বাদ পেয়েছিল।’

২০১৮ সালে রবীন্দ্রনাথের পুজা ও প্রেম পর্বের মোট মোট আটটি গানের সমাহারে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন প্রকাশ করেছিল শিমুর একক অ্যালবাম ‘তোমায় আমায় মিলে’। সিডির কাভারে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক মায়াবী কথার দুছত্র আছে। এই অ্যালবামের সব গান বেঙ্গল ফাউন্ডেশন-এর ইউটিউব চ্যানেলে আছে। আটটি গানের মধ্যে ছয়টি গানই শ্রোতাদের কাছে যে নতুন ছিল তা বলাই বাহুল্য।

গানগুলো হলো-‘পুরনো জানিয়া চেয়ো না’, ‘কেন আমারে পাগল করে যাস’, ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’, ‘কে বসিলে আজ হৃদয়াসনে’, ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান’, ‘যাবার বেলা শেষ কথাটি যাও বলে’, ‘ফুল বলে ধন্য আমি মাটির পরে’, ‘তোমার হল সুর, আমার হল সারা’।

এই অ্যালবামের প্রতিটি গানই তিনি ভীষণ যত্ন ও দরদ দিয়ে গেয়েছেন। সুরে, বিশুদ্ধ উচ্চারণে, পরিবেশনে, প্রক্ষেপণে তাই প্রতিটি গানই হয়েছে প্রাণময়। ছায়ানটে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই অ্যালবামের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছিল। এই অ্যালবামের যন্ত্রানুষঙ্গ পরিচালনা করেন হিমাদ্রী শেখর।

সঙ্গীত ভুবনে শিমু কেবলই নবীনা, চলার দীর্ঘ পথ তার বাকি। কিন্তু স্বল্প সময়েই সুুরলহরী দিয়ে শুদ্ধ সঙ্গীত পিপাসুদের হৃদয়মনে তিনি যে বেশ জায়গা করে নিয়েছেন তা স্বীকার করতেই হয়। প্রযুক্তির এই উচ্চমাত্রার যুগে আমরা সঙ্গীতের নানা উপস্থাপন, নানান ধরন দেখতে পাচ্ছি। বৈচিত্র্যময়, বিরক্তিকর উপস্থাপনেরও শেষ নেই। কিন্তু এতকিছুর ভীড়ে সুরের আদি রূপ-রস ধরে রাখার প্রচেষ্টায় আছেন তিনি। শিমু এই প্রচেষ্টার যোগ্য এক প্রতিনিধি।

শিমুর সঙ্গীতে হাতেখড়ি শৈশবেই। বাবা ছিলেন সঙ্গীত গুরু। তারুণ্যে সঙ্গীতে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ নিয়েছেন শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটি থেকে। সেই শৈশব থেকেই গান গেয়ে নানান পুরস্কার পেয়েছেন। কলকাতা থেকেও পুরস্কার পেয়েছেন। গান গাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ বেতারে প্রযোজক হিসেবে এখন কর্মসূত্রে আবদ্ধ।

জীবনের এই এতদূরে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণে রাখেন সঙ্গীতগুরু ভরত চন্দ্র, রোটনলাল সূত্রধর, ওয়াহিদুল হক, লিলি ইসলাম, সুজিত মোস্তফাসহ আরও অনেক সঙ্গীতজনকে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে গান গাওয়াটা তার বড় এক প্রাপ্তি। আর সঙ্গীত পরিচালক হিমাদ্রী শেখরকে নিয়ে বেঁধেছেন সুরের সংসার।

ডিজিটাল এই যুগে গানের উপস্থাপন সম্পর্কে শিমু দে বলেন, ‘শ্রোতাদের কাছে সঙ্গীত উপস্থাপনার ধরনটাই এখন বদলে গেছে। এখন ‘ভিউ’ বাড়ানোর চেষ্টা সবদিকে। দ্রুত গান কপি বা নকল হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃত শিল্পীরা উপকৃত না হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিটি শিল্পীর আর্থিক স্বার্থের বিষয়গুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের দেখতে হবে।’

শিমু আর বলেন, ‘আমরা যাই করি শেকড়টা ঠিক রাখতে হবে। ডিজিটালি আমাদের শিল্পীদেরও এগুতে হবে। গানগুলো শ্রোতার হাতের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’

সবশেষে বলি শিমুর নতুন পরিকল্পনার কথা। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আরও একটি নতুন ধরনের অ্যালবাম প্রকাশ করবেন। সেখানে আরও আত্মনিবেদন, আরও সুরের সম্মিলন থাকবে তার।

রবীন্দ্রনাথের নতুন নতুন গানে, নতুন প্রাণে শিমু দে আরও আলোকময় হয়ে হয়ে উঠুক-এই কামনা। শিমু দে’র নতুন নিবেদনের প্রত্যাশায় আমরাও থাকলাম।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)