চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

শিক্ষা বাজেটে শুভংকরের ফাঁকি

২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে কেউ বলছেন উচ্চাভিলাসী, আবার কেউবা বলেছেন বিশাল টার্গেটের বাজেট। একক খাত হিসেবে এবার সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষায়। এই বরাদ্দের পরিমাণ ৩১ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিলো ২৯ হাজার ২২৬ কোটি। অর্থাৎ এবার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।

খোলা চোখে দেখলে মনে হবে গত চার বছরে সামগ্রিকভাবে শিক্ষা খাতে এবারের বাজেটে বরাদ্দ সর্বোচ্চ। তবে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে ভিন্ন এক চিত্র। স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে বাজেটে আসলে বরাদ্দ কমেছে।

গত পাঁচ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়: ২০১৩-১৪ অর্থবছর ছাড়া প্রতিবারই মোট বাজেটের অনুপাত শিক্ষায় বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় কমেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট জাতীয় বাজেটের ১২.১১% বরাদ্দ ছিল শিক্ষায়। এবার শতাংশের হিসাবে ১১.০৭%, যা জাতীয় আয়ের ১.৮৪%। গত বছর অর্থাৎ ২০১৪-১৫ বাজেটে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১১.৬৬%।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষায় ঝড়ে পরার হার ৪ ভাগের একটু বেশি বলে উল্লেখ করেছেন। মাধ্যমিক শিক্ষার হতাশজনক চিত্রের কথাও বলেছেন তিনি। মাধ্যমিক শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ে বলেও বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন অর্থমন্ত্রী। যদিও গত কয়েক বছরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ব্যবস্থাসহ সামাজিক সব সূচকে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। ভর্তির হারও হয়েছে শতভাগ। এই একটি অর্জনই বাংলাদেশ পৌঁছে দিয়েছে ভিন্ন এক উচ্চতায়।

আবারো মূল প্রসঙ্গ। এবারের বাজে ভৌত অবকাঠামো, বিনিয়োগ, জ্বালানি, সড়ক, পরিবহন খাতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার ব্যাপারে এসে দেখা যায় শুভংকরের ফাঁকি।

প্রতি বছর ১৫ লাখ ছেলে-মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেয়, পাশও করে ১২ থেকে ১৩ লাখ। সাতাশটির জায়গায় এখন ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, অসংখ্য ইনস্টিটিউট হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে। সরকার যখন ঘোষণা দিয়েছে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় করবে, প্রতিদিন জনসংখ্যার যে স্রোত, প্রাথমিকে শতভাগ ভর্তি, এর সঙ্গে তাল মিলিয়েই তো বাজেট হবে। কিন্তু সেটা মনে হয় হয়নি।

এটাও ঠিক সীমাবদ্ধতাও আছে, আমাদের বাজেট সীমিত, তারপরও বলবো: যদি মানসম্মত জাতি গঠন করতে চাই তাহলে তো প্রশিক্ষিত জনশক্তি লাগবে, তাহলে তো জ্ঞানী সমাজ লাগবে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান লাগবে। এগুলো কে করবে? এগুলো করবে শিক্ষা। আর এ জন্যই শিক্ষায় বিনিয়োগ হবে ভালো। আর সেই বিনিয়োগ করতে হবে যতো কষ্টই হোক।

ভারত যদিও বিশাল তারপরও দেশটি কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে আমাদের চেয়ে খুব একটা শক্ত অবস্থানে নেই। উন্নয়ন সূচকের প্রায় সবগুলোতেই আমরা ভারতের সমান। সেখানে জাতীয় আয়ের ৩.৮% শিক্ষায় বরাদ্দ। আমরা ওই পরিমাণে বরাদ্দ দিতে না পারলেও এর চেয়ে এক ভাগ কম দেওয়ার সামর্থ্য তো আমাদের আছে। মালয়েশিয়ায় শিক্ষায় বরাদ্দ জাতীয় আয়ের ৬-৭%। মালদ্বীপে ৮% আর আমাদের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্র নেপালেও শিক্ষায় বরাদ্দ জাতীয় আয়ের ৩%।

আমরা তো ২০৪০ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম লিখাতে চাই। তাহলে এখন থেকেই তো উন্নত বিশ্বের দু’একটা উদাহরণ দিতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশেও ১.৮৪ শতাংশের বেশি বরাদ্দ শুধু উচ্চ শিক্ষাতেই। আর উন্নত দেশের চিত্র পুরোপুরি আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শিক্ষায় বরাদ্দ ২.৭%। শিক্ষায় বরাদ্দ তো ৮ শতাংশের এর উপরে।

তাহলে তাদের সঙ্গে আমরা কি করে প্রতিযোগিতা করবো? আমাদের মেধা দিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হবে। গ্লোবাল মার্কেটে তো আমাদের পক্ষে কিছু নাই। আমাদের কমপিটিশনে তো টিকে থাকতে হবে। কমপিটিশনের জন্য প্রয়োজন জ্ঞান এবং দক্ষতা। এই খাতের বিনিয়োগই হচ্ছে সেরা বিনিয়োগ। এটা দিয়েই সব উত্তরণ সম্ভব। পদ্মা সেতু করবো প্রকৌশলী আর প্রযুক্তি তো সব বিদেশ থেকেই আসছে। উন্নত দেশ করতে হলে তো নিজেদেরকেও প্রকৌশলী বানাতে হবে, প্রযুক্তির ব্যবহার দেখাতে হবে। এই বাজেট দিয়ে কি তা সম্ভব?

আমরা যে স্যাটেলাইট করবো তাও তো করে দেবে বিদেশীরা। একমাত্র শিক্ষা খাতে বিনিয়োগই আমাদের স্বপ্ন দেখাতে পারে এখন বিদেশীরা করলেও নিশ্চিত ভাবেই একসময় আমরা স্যাটেলাইট ওড়াবো।

নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্ট্রাকচার দিতে হবে, শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে গেলে তো অর্থ লাগবে। আমাদের শিক্ষানীতিতে কথা ছিলো শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে-স্কেল ঘোষণা করা হবে। বাজেটে তো এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। বরং এখন শিক্ষকদের পে-স্কেল থার্ড গ্রেডে নিয়ে আসা হয়েছে। কেবিনেট সেক্রেটারি, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি, সিনিয়র সেক্রেটারি তারপর প্রফেসর। এখানেও তো শিক্ষা খাতকে অবজ্ঞা করা হয়েছে।

একটি উদাহরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। ফিলিপাইনের ১৫ লাখ মানুষ প্রবাসী। তবে তারা প্রায় সবাই প্রশিক্ষিত। ৩৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায় তারা। আর বাংলাদেশের দেড় কোটি মানুষ প্রবাসী। রেমিট্যান্স পাঠায় মাত্র ১৫ বিলিয়ন। কারণ শিক্ষিতরা সব সময়ই এগিয়ে থাকে। এটা সবাইকে বুঝতে হবে।

আমরা বিশ্বাস করতে চাই, মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান উপায় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খাতে সরকার যথাযথ বিনিয়োগ করবে। আর এই বিনিয়োগের ফল মুহূর্তের মধ্যে পাওয়া যাবে না সত্যি, কিন্তু দেশ যে তরতর করে সামনে এগিয়ে যাবে সেটা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়।