করোনা মহামারী শুধু বাংলাদেশে নয়-পৃথিবীব্যাপী এই ভাইরাসটি শত শত কোটি মানুষের জীবন ও সংসার তাবৎ সামাজিকতা এবং জীবনের আরও বহু প্রয়োজনীয় দিক বিপর্যস্ত করে রেখেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়ে পড়েছে সর্বত্র মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। এই ভাইরাসের সংক্রমণের হাত থেকে পৃথিবী কবে রেহাই পেয়ে মানুষ কবে তার স্বাভাবিক পারিবারিক, সামাজিক, পেশাগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন যাত্রায় ফিরে আসতে পারবে-তা আজও সকলের কাছেই অজানা।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু শুরু হয় ২০২০ সালের মার্চ থেকে। এ যাবত তা যে বহাল রয়েছে তাই নয়, তার অভিঘাত দিনে দিনে ভয়াবহভাবে বেড়েই চলেছে। আজ ২১ জুলাই যখন এটা লিখতে বসেছি তখন হাতে আমার ২০ জুলাই এর সরকারি তথ্য। তাতে দেখা যায় ঐদিন সংক্রমিত হয়েছে এ যাবত সর্বোচ্চ ১৩,০০০ এর বেশি-মৃত্যুও ঘটেছে ২৩১ জনের যা এ যাবত সর্বোচ্চ। এ পরিস্থিতির আরও অনেক বেশী অবগতি আগামি ২৩ সপ্তাহে অর্থাৎ আগস্টের প্রথম-দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ঘটবে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন। এই প্রথমবারের মত স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বয়ংও এই ধরণের আশংকা প্রকাশ করেছেন প্রকাশ্যে।
করোনা মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রকেই তছনছ করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক জীবন-সামাজিক জীবন-রাজনৈতিক জীবন প্রভৃতির কথা আগেই বলেছি।
কিন্তু যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বাধিক ক্ষতির শিকারে পরিণত হয়েছে তা হলো শিক্ষাক্ষেত্র। সেই যে ২০২০ এর মার্চে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলো-আজ এই ২০২১ এর জুলাই পর্যন্ত বিস্ময়কারভাবে তা অব্যাহত রয়েছে। শিক্ষাঙ্গন সমূহের প্রাঙ্গণে সবুজ ঘাসের বিস্তার ঘটেছে শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারণর অভাবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অফিস যদিও প্রতিদিনই কিছুক্ষণ করে খোলা থাকছে তাতে কোন ইতর বিশেষ ঘাস গজানো ও তার অব্যাহত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহের মাঠগুলি গো-চারণের অবাধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি দফায় দফায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ থাকার মেয়াদ বাড়িয়ে চলেছেন। এই মেয়াদ বৃদ্ধি সমাপ্তি কবে রচিত হবে তা-ও সবারই অজানা। মাঝখান থেকে লক্ষ লক্ষ ছাত্র ছাত্রীর জীবন থেকে দুটি অমূল্য বছর হারিয়ে গেল।
এখানে বলতে বা মানতে আদৌ কোন দ্বিধা নেই যে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষায় সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সরকার বলছেন, এই করোনা সংক্রমণের ও অজস্র মৃত্যুর মুখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি খুলে দিলে তাদের জীবনকেও কি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া সঙ্গত হবে?
কথাটি পুরোপুরি ফেলে দেওয়ার মত যদিও নয়-তবু দৃঢ়তার সাথে বলতেই হবে জীবনের সর্বাধিক মূল্যবান অংশই হলো শিক্ষাজীবন। এক মুহূর্তের জন্যও এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, মানুষের জীবনের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা হলো অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান। বেশি দামি হোক আর কম দামি হোক অন্ন বস্ত্রের ব্যবস্থা মানুষকে করতেই হয়। এ দুটির দায়িত্ব পরিবারের অভিভাবক অভিভাবিকাদের। কিন্তু শিক্ষা চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের।
সুতরাং শিক্ষাক্ষেত্রে সরকার কোনক্রমেই অবহেলা করতে পারেন না। শিক্ষার মাধ্যমেই ছেলে-মেয়েরা দেশটার কর্ণধার হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তোলার সুযোগ পেতে পারে। শিক্ষা এবং সুশিক্ষার মাধ্যমেই তারা হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, পুষ্টিবিদ, এম.পি. মন্ত্রী প্রভৃতি এবং শিক্ষা হলো জীবনের নিরন্তর প্রক্রিয়া।
সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মৌলিক বিষয়টির গতি প্রায় দুটি বছর যাবত এক নাগাড়ে বাংলাদেশে গতিহীন হয়ে পড়ে আছে। এই প্রজন্ম কি তবে ভবিষ্যতে সম্মানে নিজেদের পায়ের উপর দাঁড়াবে মধ্য যৌবনে গিয়ে? বয়স ৩০ এর উপরে ওঠার পারে? এই বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে-শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জীবন বা বেঁচে থাকাকে গুরুত্ব দিলে তার পরিণতিতে আমাদের ভবিষ্যৎ জাতীয় জীবনে এক মারাত্মক শূণ্যতা নেমে আসতে বাধ্য। আর তেমন শূণ্যতা নেমে যা হবে মারাত্মক ক্ষতিকারক।
সরকার অবশ্য শূণ্যতা পূরণের লক্ষ্যে কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। যেমন:অটো পাস। আমাদের জীবনে ১৯৭২ এ এই ব্যবস্থা তৎকালীন সরকারকে নিতে দেখেছিলাম। তার ফল শুভ হয় নি। এবারের অটো পাশের পরিণতিও শুভ হবে না-যদি উচ্চতর স্তরে ভর্তি হতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় তখনই আমরা অটোপাশের মাহাত্ম জানতে পারবো। বহু ছেলে মেয়ের চোখের জলের বন্যা নেমে আসবে তেমন পরিস্থিতিতে-তাতে কোন সন্দেহ নেই।
অতীতে জি.পি.এ ফাইভ, গোল্ডেন ফাইভ পাওয়া বহু ছাত্র-ছাত্রীর এমন দুর্দশায় পড়তে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা মেডিক্যাল কলেজ বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে।
সরকার আরও একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। সেটি হলো অনলাইন পড়াশুনা ও পরীক্ষা দেওয়া। এই ক্ষেত্রেও সরকারি ব্যর্থতা পর্বত প্রমাণ। কারণ অনলাইন পড়াশুনায় শিক্ষার্থীরা মোটেও আকর্ষণ বোধ করে নি তারা শুয়ে বসে, আড্ডা মেরে সময় কাটিয়েছে অপরদিকে অনলাইন পরীক্ষা দিয়েছে নিজ নিজ বাড়িতে বসে বই খুলে সামনে রেখে। এটিও ব্যর্থ হলো।
অপর সমস্যা হলো শহরে আমরা শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন বা ইন্টারনেট দেখলেও গ্রামাঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের অন্তত: ৬০ ভাগের ক্ষেত্রেও তা সত্য নয়। কারণ তাদের হাতে আজও স্মার্ট ফোন বা ল্যাপটপ পৌঁছেনি।
এই বাস্তবতাগুলিকে গভীরভাবে বিবেচনায় নিয়ে স্পষ্টতই বুঝা যায় জীবনের ঝুঁকিও কমাতে হবে এবং সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলে দিতে হবে এবং তা সর্বোচ্চ তিনমাস অর্থাৎ আগামী অক্টোবর থেকেই।
কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব?
এ ব্যাপারে আমার অভিমত হলো নিন্মরূপ:
এক. যখন থেকে প্রথম করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছিলো তখন অগ্রাধিকার ঘোষণা করা হয়েছিল ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। অত:পর সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও করোনা এলাকায় (হাসপাতাল সহ) কর্তব্যরত পুলিশদেরকে।
এ ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলো এক্ষেত্রে একটা মারাত্মক ভুল করা হয়েছিল-চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পরেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত ছিল।
আবার বয়সের ক্ষেত্রে ৪০ বছর এবং অনূর্ধ্ব বয়সীদেরকে প্রাধান্য দেওয়া হলো। এটিও ভুল। প্রথমত: ষাটোর্ধদেরকে ভ্যাকসিন দিয়ে ১২ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের দিলে শিক্ষার্থীদেরকে দেওয়া যেত। তাতে সম্ভবত: বিগত জুন থেকে আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে চালু করতে পারতাম। তাতে একটা বছর ক্ষতির হাত থেকে শিক্ষার্থীদেরকে বাঁচানো যেত।
কিন্তু ভুলভ্রান্তি যা হবার তা হয়ে গেছে। কিন্তু করণীয় হলো সরকারি তথ্যমতে আগামী আগস্টের মধ্যে সাকুল্যে দুই কোটি ডোজ টিকা নানাদেশ এবং নানা সূত্র থেকে আমরা পেয়ে যাব।
তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি যত দ্রুত সম্ভব খুলবার জন্য-
এক. টিকার বয়ো:সীমা ৩০ নয়-তা ১২ বছরে নামিয়ে আনা হোক। এতে আমরা প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত টিকা দিতে সক্ষম হবো। টিকাদান সমাপ্ত (শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে) করার জন্য সর্বোচ্চ তিন মাস নির্ধারণ করা হোক।
দুই. একই সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি খোলার দিন তারিখ সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হোক। আমার প্রস্তাব ১ অক্টোবরের ২০২১ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি চালু করা এবং ক্লাস শুরু করা;
তিন. ১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি রুমের অভ্যস্ত, সকল দরজা, জানালা, টেবিল-চেয়ার ও বেঞ্চগুলি, বাইরের বারান্দা, মাঠ সর্বত্র ডিস- ইনফেট্যান্ট স্প্রে সপ্তাহে দুই, তিন ধরে করা শুরু করা হোক।
চার. টিকাদানের ক্ষেত্রে প্রথম মাসে ১২ থেকে ২২ বছর পর্যন্ত টিকা দিলে দ্বিতীয় মাস-অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলি খোলা সম্ভব হতে পারে। শিক্ষকদের ও যেটি রুমের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যেতে পারে-যাতে তাঁরা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে বসতে পারেন।
পাঁচ. শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশী হলে পঞ্চম ও চতুর্থ-শ্রেণী সপ্তাহে চার দিন এবং বাকী দু’দিন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর ছেলে মেয়েদের পাঠদান দূরত্ব বজায় রেখে করা যেতে পারে।
ছয়. অক্টোবর থেকে বাধ্যতামূলক বাদ বাকী সকল স্তরে শিক্ষাদানের জন্য সকলের টিকাদান শেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হল, হোস্টেল প্রভৃতি খুলে দেওয়া এবং ডিস-ইনফেট্যান্ট প্রক্রিয়া আগে থেকে সুরু করে নিয়মিত তা অব্যাহত রাখা।
এভাবে আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে জমে ওঠা সংকট কাটিয়ে উঠে এক বছর বাঁচাতে পারি এবং সে পথে দৃঢ়তা ও আন্তরিকতার সাথে এখন থেকেই কাজ শুরু করা প্রয়োজন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)