এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের অবসরকালীন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের পাওনা দ্রুত নিস্পত্তি করার লক্ষ্যে শিক্ষক কর্মচারীদের চাঁদা বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর বক্তব্যে শিক্ষক কর্মচারীসহ সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের আর্থিক সংকটের কারণ, সমাধানের উদ্যোগ ও বাস্তব বিভিন্ন বিষয় আমার লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি ব্যাখ্যা প্রদান করা উচিত বলে আমি মনে করি।
পূর্বকথন: এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়া পত্তন থেকেই শিক্ষকতা পেশায় দেশের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানেরাই শুধুমাত্র দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিনা বেতনে শিক্ষকতা পেশায় আসতেন। ১৯২০খ্রি. পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষকদের কোন বেতন ব্যবস্থা ছিল না। শিক্ষকদের দাবির প্রেক্ষিতে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা বেতন ব্যবস্থা প্রচলন করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকার শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের পাশাপাশি বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের বেতন ১০০ টাকা এবং স্কুল শিক্ষকদের বেতন ৭৫ (পঁচাত্তর) টাকা নির্ধারণ করেন (তখন অধ্যক্ষ কিংবা প্রধান শিক্ষকদের আলাদা কোন বেতন ছিল না)।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীরা সারাজীবন চাকরি করে এক সময় শুন্য হাতে বাড়ি ফিরতেন। তাদের কোন ‘পেনশন’ ব্যবস্থা ছিল না। অবসরগ্রহণের পর শিক্ষার্থীরা চাঁদা তুলে শিক্ষকদের বিদায় অনুষ্ঠানে তাদের হাতে ছাতা, জায়নামাজ, লাঠি, তসবি তুলে দিতো। বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের অবসরকালীন দূরাবস্থার কথা চিন্তা করেই বঙ্গবন্ধু সরকার তাদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর সেই উদ্যোগ আর বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষকদের দাবির প্রেক্ষিতে এরশাদ সরকার ১৯৯০ সালে কল্যাণ ট্রাস্ট চালু করে। কিন্তু মাত্র ৬ মাস সচল থাকার পর ১৯৯১ সালে কল্যাণ ট্রাস্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৯১খ্রি থেকে ১৯৯৬খ্রি. পর্যন্ত খালেদা জিয়া সরকার কল্যাণ ট্রাস্ট বন্ধ রাখে। ১৯৯৬খ্রি. জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে কল্যাণ ট্রাস্ট পুনরায় চালু করা হয়।
কল্যাণ ট্রাস্টের আইন অনুযায়ী শিক্ষক কর্মচারীদের বেতনের ২% টাকা কল্যাণ ফান্ডে জমা করা হয় এবং তাদের অবসরকালীন সময়ের সর্বশেষ বেতন স্কেল অনুযায়ী যত বছর চাকরি তত মাসের (১৯৯০ সাল থেকে) সমপরিমাণ টাকা কল্যাণ সুবিধা প্রদান করা হয়। ২০০৬ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কল্যাণ ট্রাস্ট বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে পারেনি।
অবসর বোর্ডের আইন অনুযায়ী শিক্ষক কর্মচারীদের বেতনের ৪% চাঁদা জমা রাখা হয় এবং একজন শিক্ষক কর্মচারী ৭৫ (পঁচাত্তর) মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অবসর ভাতা পেয়ে থাকেন।
কল্যাণ ও অবসর ভাতা আর্থিক সংকটের কারণ : কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বন্ধ থাকায় ৬ (ছয়) বছর শিক্ষকদের চাঁদা ফান্ডে জমা না হওয়ায়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাৎসরিক ৫ (পাঁচ) টাকা চাঁদা ২০০২ সালে বন্ধ করে দেয়া এবং জাতীয় পে-স্কেলে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে নতুন স্কেলে তাদের কল্যাণ ও অবসর ভাতা প্রদান করতে যেয়ে এই আর্থিক সংকট দেখা দেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৮০ সালে বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পর্যায়ক্রমে জাতীয় স্কেলে ১০০% বেতন উন্নীত হয়। ২০০৬ সালে ৯০% থেকে ১০০% উন্নীত করতে শিক্ষকদের আন্দোলনে রাজপথের মিছিলে পুলিশের হামলায় আমি নিজে রক্তাক্ত আহত হয়েছিলাম।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ৭ম জাতীয় পে-স্কেলে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ৬২% বৃদ্ধির ফলে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডে আর্থিক সমস্যা দেখা দেয়। কারণ কল্যাণ ট্রাস্টে ২% এবং অবসর বোর্ডে ৪% করে যে চাঁদা জমা হয় তা দিয়ে অর্ধেক আবেদনও নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না। ফলে বছর শেষে বিপুল সংখ্যক আবেদন অনিষ্পন্ন থেকে যায়। ২০১৫ সালে ৮ম জাতীয় বেতন স্কেলে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ১০০% বৃদ্ধি পায়। ফলে কল্যাণ ও অবসর বোর্ডে নতুন স্কেলে তাদের পাওনা পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। উদাহরণ স্বরূপ বলা য়ায় ২০১৫ সালের ৩০ জুন একজন কলেজ অধ্যক্ষ অবসরগ্রহণ করলে তিনি ২৫ হাজার টাকা স্কেলে কল্যাণ ও অবসর বোর্ড থেকে প্রায় ২৩ লক্ষ টাকা পেয়ে থাকেন অথচ একদিন পর অর্থাৎ ২০১৫ সালের ১ জুলাই যিনি অবসরগ্রহণ করেছেন তিনি পাবেন দ্বিগুণ অর্থাৎ প্রায় ৪৬ লক্ষ টাকা। কল্যাণ ট্রাস্ট এর আইন অনুযায়ী ১৯৯০ সাল থেকে তিনি কল্যাণ সুুবিধা পেয়ে থাকেন। অথচ ৯০ সাল থেকে সেই অধ্যক্ষ ছিলেন প্রভাষক। তার স্কেল ছিল মাত্র ১৬৫০ টাকা। তখন বেতন ছিল জাতীয় বেতন স্কেলের ৮০%। অর্থাৎ ঐ অধ্যক্ষ সাহেব তখন জমা দিয়েছেন ১৬৫০ টাকার ৮০% এর ২%। তিনি ন্যূনতম ১২ বছর প্রভাষক ছিলেন। অথচ আইন অনুযায়ী সর্বশেষ তার প্রাপ্ত অধ্যক্ষের ৫০ হাজার টাকা স্কেলে ৯০ সাল থেকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। অনুরূপ প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য স্তরেও একইভাবে সুবিধা প্রদান করতে হয়। ফলে দেখা যায় একজন শিক্ষক কিংবা কর্মচারী চাঁদা বাবদ যে অর্থ জমা দেন তার প্রায় ১৮/১৯ গুণ বেশি টাকা তিনি কল্যাণ ও অবসর সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এই অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্ধ না থাকায় কল্যাণ ও অবসর বোর্ডে আর্থিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করে।
সংকট সমাধানের উদ্যোগ: ২০১৫ সালে জাতীয় বেতন স্কেলে বেতন বিগুণ বৃদ্ধির কারণে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডে চরম আর্থিক সংকট দেখা দেয়। অর্থের অভাবে প্রায় ৭৫ হাজার শিক্ষক কর্মচারীগণের আবেদন অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে থাকে। এমতাবস্থায় সংস্থা দুইটির চেয়ারম্যান শিক্ষা সচিব এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হলো শিক্ষক কর্মচারীগণ কল্যাণ এবং অবসর সুবিধা বোর্ডে ৬% চাঁদা দিয়ে পূর্বে যে সুবিধা পেতেন নুতন স্কেলে তার দ্বিগুণ সুবিধা পাচ্ছেন। সুতরাং তাদের চাঁদার পরিমাণ দ্বিগুণ অর্থাৎ ১২% হওয়া উচিত। আমি সেদিন সেই সভায় বলেছিলাম, শিক্ষকরা যে বেতন পায় সেই টাকায় তাদের সংসার চালানো অনেক কষ্টসাধ্য। আমি সরকার থেকে অর্থের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করি। অনেক যুক্তি তর্কের পর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দুরাবস্থার কথা বিবেচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের সেই সভায় শিক্ষকদের চাঁদা বৃদ্ধি করে সরকার থেকেও অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি এই সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শিক্ষা সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কল্যাণ ট্রাস্ট এবং অবসর সুবিধা বোর্ডের বোর্ড সভায় কল্যাণ ট্রাস্টে ২% এবং অবসর সুবিধা বোর্ডে ২% চাঁদা বৃদ্ধির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই সভায় কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের সকল সদস্য উপস্থিত থেকে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারীদের দুর্দশা লাঘবের জন্য সবাই একমত হন। ১৫-০৩-২০১৬খ্রি. তারিখে অনুষ্ঠিত কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের পৃথক পৃথক সভায় শিক্ষা সচিব, মাউশির ডিজি, কারিগরির ডিজি-সহ সভায় ২১ জন সদস্যের সকলেই উপস্থিত ছিলেন। সেই সভায় জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন শিক্ষক ও কর্মচারী প্রতিনিধি যথা স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি- আবু বকর-কাসেম গ্রুপ, কামরুজ্জামান গ্রুপ, আজিজুল হক গ্রুপ, জমিয়েতুল মোদারেসিন এবং কর্মচারী ফেডারেশনের বিভিন্ন গ্রুপের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের সংকট নিরসনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৭০০ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০০ কোটি টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে ৭৫৭ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের শর্ত অনুযায়ী কল্যাণ ও অবসর সুবিধা বোর্ডের চাঁদা বৃদ্ধি না করায় এই অর্থ আটকে দেয়। তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পরবর্তীতে শিক্ষকদের দাবির মুখে তা স্থগিত করা হয়। তখন শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ৫% ইনক্রিমেন্ট দেয়ার পর কর্তন করা হলে তাদের আপত্তি থাকবে না। এবার ৫% ইনক্রিমেন্ট এবং ২০% বৈশাখী ভাতা দেয়ার পর যখন চাঁদা কর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয় তখন আবার শিক্ষকদের পক্ষ থেকে এর বিরোধীতা করা হচ্ছে।
শিক্ষক কর্মচারীদের মূল বেতনের সাথে ৫% ইনক্রিমেন্ট যোগ হওয়ার ফলে শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ড থেকে ৫ বছর ও ১০ বছর পরে কল্যাণ ও অবসর সুবিধা প্রাপ্তির তুলনামূলক বিবরণী :
বেতন কোড |
পদবী |
বেতন স্কেল |
২০১৮ সালে কল্যাণ সুবিধা প্রাপ্তি |
২০১৮ সালে অবসর সুবিধা প্রাপ্তি |
৫% ইনক্রিমেন্ট
বৃদ্ধির ফলে ২০২৩ সালে মূল বেতন |
২০২৩ সালে কল্যাণ সুবিধা প্রাপ্য |
২০২৩ সালে অবসর সুবিধা প্রাপ্য |
২০২৮ সালে মূল বেতন হবে |
২০২৮ সালে কল্যাণ সুবিধা প্রাপ্য |
২০২৮ সালে অবসর সুবিধা প্রাপ্য |
৪. |
অধ্যক্ষ |
৫০.০০০/- |
১৩,৯৯,৯৫০/- |
৩১,৪৯,৯৫০/- |
৬০,৮৪০/- |
২০,০৭,৬৭০/- |
৪১,৩৭,০৭০/- |
৭৪,৪০০/- |
২৮,২৭,১৫০/- |
৫৪,৩১,১৫০/- |
৭. |
প্রধান শিক্ষক |
২৯,০০০/- |
৮,১১,৯৫০/- |
১৮,২৬,৯৫০/- |
৩৭,০৩০/- |
১২,২১,৯৪০/- |
২৫,১৭,৯৯০/- |
৪৭,৩০০/- |
১৭,৯৭,৩৫০/- |
৩৪,৫২,৮৫০/- |
৯, |
প্রভাষক |
২২,০০০/- |
৬,১৫,৯৫০/- |
১৩,৮৫,৯৫০/- |
২৮,১০০/- |
৯,২৭,২৫০/- |
১৯,১০,৭৫০/- |
৩৫,৮৮০/- |
১৩,৬৩,৩৯০/- |
২৬,১৯,১৯০/- |
১০. |
সহ. শিক্ষক |
১৬,০০০/- |
৪,৪৭,৯৫০/- |
১০,০৭,৯৫০/- |
২০,৪৪০/- |
৬,৭৪,৪৭০/- |
১৩,৮৯,৮৭০/- |
২৬,১২০/- |
৯,৯২,৫১০/- |
১৯,০৬,৭১০/- |
১৯. |
অফিস সহায়ক |
৮,৫০০/- |
২,৩৭,৯৫০/- |
৫,৩৫,৪৫০/- |
১০,৮৭০/- |
৩,৫৮,৬৬০/- |
৭,৩৯,১১০/- |
১৩,৯০০/- |
৫,২৮,১৫০/- |
১০,১৪,৬৫০/- |
কল্যাণ ট্রাস্ট এবং অবসর সুবিধা বোর্ডে প্রতিমাসে যে পরিমাণ চাঁদা জমা হয় তার দ্বিগুণের বেশি অর্থের প্রয়োজন পড়ে। বছরে যে পরিমাণ চাঁদা জমা হয় তা দিয়ে অর্ধেক আবেদন নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়। বাকি অর্ধেক আবেদন অনিষ্পন্ন থেকে যায়। এবার ৫% ইনক্রিমেন্ট চালু হওয়ার ফলে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন সরকারি চাকরিজীবীদের অনুরূপ প্রতি বছর চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকবে। ফলে ১০ বছর পর কল্যাণ ও অবসর সুবিধা বোর্ডের শিক্ষক কর্মচারীদের পাওনার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এছাড়া সরকার থেকে যদি নতুন কোন সুবিধা প্রদান করা হয় তাহলে কল্যাণ ট্রাস্ট এবং অবসর সুবিধা বোর্ডের আর্থিক সংকট আরো বেড়ে যাবে। ফলে চাঁদার পরিমাণ বৃদ্ধি কিংবা সরকারি বরাদ্দ না দেয়া হয় তাহলে সংস্থা দুইটি অকার্যকর হয়ে পড়বে। ফলে লক্ষ লক্ষ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারী তাদের পাওনা থেকে বঞ্চিত হবেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারীদের শেষ আশ্রয়স্থল কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের সংকট নিরসনের জন্য অতীতে কোন সরকার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অবসর বোর্ডে এককালীন ৮৯ কোটি টাকা সীড মানি দেয়া হলেও কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার পর থেকে একটি টাকাও কোন সরকার বরাদ্দ দেয়নি। বর্তমান শিক্ষা বান্ধব শেখ হাসিনা সরকার গত তিন অর্থ বছরে এই দুইটি সংস্থায় শিক্ষক কর্মচারীদের চাঁদা বৃদ্ধির শর্তে প্রায় ১৬২৭ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়। উক্ত বরাদ্দের পরও শিক্ষকদের চাঁদা বৃদ্ধি না করা হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট শর্ত রয়েছে তারা এ খাতে নূতন করে আর কোন অর্থ বরাদ্দ দিবে না। এমতাবস্থায় শিক্ষক এবং সরকার উভয়কেই বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। স্বল্প আয়ের শিক্ষকদের আর্থিক দিক যেমন বিবেচনা করা উচিত, তেমনিভাবে শুধু সরকারকেই দিতে হবে এই বিষয়টিও ভাবতে হবে। তবে চাঁদা বৃদ্ধির সাথে বিদ্যমান সুবিধার পাশাপাশি সর্বশেষ স্কেলে কল্যাণ ট্রাস্টে আরো অতিরিক্ত কিছু সুবিধা প্রদান করা হলে শিক্ষকরা লাভবান হবেন। এছাড়াও শুধুমাত্র সরকারের সাহায্যের উপর নির্ভর না করে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডকে বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে আয়বর্ধক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। যে উদ্যোগ ইতিমধ্যে নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে এখন প্রয়োজন সকলের সহযোগিতা।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৮ বছর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে ১৮ বছর। দীর্ঘ ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী বিরোধী শক্তি। তারা শিক্ষার উন্নয়নে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে সেটাও বিবেচনা করতে হবে। গত দশ বছর বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার শিক্ষাখাতে যে যুগান্তকারী উন্নয়ন করেছে বিগত ৩৮ বছরেও তা হয়নি। ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, প্রতিটি উপজেলা সদরে একটি করে স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ, বেসরকারি শিক্ষকদের মেডিকেল ও বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, ৫% ইনক্রিমেন্ট, ২০% বৈশাখী ভাতা প্রদান, কল্যাণ ও অবসর সুবিধার জন্য ১৬২৭ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ, মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, সারা দেশে শিক্ষাঙ্গণে ব্যাপক হারে অবকাঠামো উন্নয়ন, জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্ব মুহূর্তে গণভবনে শিক্ষা সচিব, আমি এবং অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিবকে সামনে রেখে ৫% ইনক্রিমেন্ট, ২০% বৈশাখী ভাতা, কল্যাণ এবং অবসর বোর্ডের জন্য ৭৫৭ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে সরকারি বেসরকারি বৈষম্য দূর হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করা হলে শিক্ষার মান ও শিক্ষকের মর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে।
শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সময়ের পরিবর্তনের সাথে শিক্ষকদের জীবনমান ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন এখন আর শুধু ছাতা, লাঠি, জায়নামাজ আর তসবি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় না। বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীরা অবসরগ্রহণের পর এখন সম্মানজনক কল্যাণ ও অবসর সুবিধার টাকা পাচ্ছেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)