শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড আর যিনি শিক্ষা দিয়ে থাকেন সেই মহান শিক্ষক পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য চালিকাশক্তি। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা, উদারনৈতিক পেশা, মানবিকতার ব্রত নিয়েই শিক্ষকেরা এই পেশায় আসেন। কারণ, অন্য যে কোন উপাদান ছাড়াই পাঠদান সম্ভব, ব্যতিক্রম কেবল শিক্ষক। অর্থাৎ শিক্ষক ছাড়া শিক্ষা কাঠামোর বাস্তবতা চিন্তা করাই অকল্পনীয়।
শিক্ষকতা একটি ধৈর্যের পেশা আর এ পেশাই একমাত্র পেশা যেখানে শিক্ষকেরা আত্নমর্যাদা এবং দায়িত্ববোধের মিশেলে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। সেবার ব্রত নিয়েই এখানে শিক্ষকেরা আসেন যেখানে অর্থকড়ির বিষয় গৌণ। আর্থিক বিষয়ের সংশ্লিষ্টতা থাকলে কিংবা কারো মনে অর্থ উপার্জনের আকাঙ্ক্ষা থাকলে শিক্ষকতা পেশায় আসাটা সমীচিন নয়। তবে শিক্ষার বাণিজ্যকরণ নিয়ে মাঝে মধ্যেই খবরের কাগজে নিউজ হয় যেমন: কোচিং বাণিজ্য, ছাত্রদের প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করানো, প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত সন্দেহে খবর বেরোয়, মাঝে মধ্যে পরিমলের মতো শিক্ষকদের দেখতে হয় আমাদের, এ সকলি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য। তথাপি আমার এখনো বিশ্বাস, অধিকাংশ শিক্ষক নিজেদের দায়িত্ববোধ ও নিজস্ব ভাললাগা থেকে এই মহান পেশায় আসেন। যেখানে ইজ্জত তথা সম্মানের সাথে মর্যাদাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ শিক্ষকতা পেশাটা সম্পূর্ণই দায়িত্ববোধের এবং সম্মানের। যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই শিক্ষকদের কাজের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। আর তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন শিক্ষকেরা। যেখানে সারাদিনের নিদারুণ পরিশ্রমকে তাচ্ছিল্য মনে হয় শিক্ষকদের নিকট।
শিক্ষক সমাজকে কোন কারণ ব্যতিরেকে কিংবা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারণে যদি লাঞ্চিত হতে হয় তাহলে সেটা কোনভাবেই কাম্য নয়। আমাদের শিক্ষাগুরুদের কোনভাবেই অপমানের শিকার হতে দিতে পারিনা। যদি কোন শিক্ষক কোনভাবে ব্যথিত হয়, অপমানিত হয়, শারীরিক লাঞ্চনার শিকার হয় তাহলে সে দায় আমাদের গোটা সমাজের উপর বর্তায়, রাষ্ট্রও কখনো এর দায় অস্বীকার করতে পারে না। কারণ, গুণীজনদের মর্যাদা বলবৎ করার দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্রের। ধিক্কার সেই সব অবুঝদের প্রতি যারা মানুষ গড়ার কারিগরদের সাথে বেয়াদবি করার সাহস দেখায়। এ সব নালায়েকদেরও কিন্তু হাতে কলমে পাঠদান করায় কোন না কোন শিক্ষক।
ছোটকাল থেকেই একজন শিক্ষককে দেখে আসছি, ওনার আদর্শকে লালন করে মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেখেছি কত সংগ্রাম করে সংসার চালাতেন, কারণ শিক্ষকতা করতেন তিনি (আয় ছিল নিতান্ত সামান্যই)। অন্য পেশার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি শিক্ষকতাকেই মনে লালন করেছিলেন। ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াশোনার খোঁজখবর নিতেন, অভিভাবকদের উৎসাহ প্রদান করতেন তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার বিষয়ে। ক্লাসরুমে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে ছাত্রদের শেখাতেন। কোন পড়া কারো বুঝতে অসুবিধা হলে বারংবার বোঝানোর চেষ্টা করতেন। কোন ছাত্রের পরীক্ষার সময় ফি দেওয়ার সমস্যা দেখা দিলে নিজ পকেট থেকে ফি দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর মিষ্টি নিয়ে হাজির হতেন ছাত্র-ছাত্রীদের বাসায়। পাশাপাশি কোন ছাত্রের ফল খারাপ হলে সান্ত্বনা দেওয়ার কাজটি শিক্ষক মহোদয় ঠিকই করতেন। আমি এমন শিক্ষককেই দেখে আসছি, সুতরাং এই শিক্ষকের উপর যখন হাত তোলা হয় তখন বিবেক বারংবার নাড়া দেয়। আমরা কোন সমাজে বাস করছি, আর কত সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিলে আমাদের বোধোদয় হবে। তড়িৎ গতিতে এ ব্যাপারে সামাজিক উদ্যোগ না নিলে যে কোন সময় নৈতিকতার চরম বিপর্যায় দেখা দিবে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে নিবন্ধটিতে। জাতি হিসেবে আর কতটা হেয় হতে হবে আমাদের যেখানে মানুষ গড়ার কারিগরদের কোন কারণ ছাড়াই হতাহত হতে হচ্ছে। শিক্ষক নির্যাতনের বিষয়টি স্কুল থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গড়িয়েছে। এ রকম অবস্থা চলতে থাকলে জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের কারিগরদের পেশার প্রতি কর্তব্যবোধ দিনকে দিন কমে আসবে। পত্রিকার খবরের মাধ্যমে জানা যায়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শিক্ষকেরা ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের হাতে আহত হয়েছেন। কেন হয়েছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এক শিক্ষককে সরিয়ে অন্য শিক্ষককে নিয়ম বহির্ভূতভাবে পদায়ন করায় শিক্ষকরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলো ভিসিকে অবরোধ করে। এর জের ধরেই ভিসিপন্থী ছাত্ররা আন্দোলনকারী শিক্ষকদের মারধর করে ভিসিকে মুক্ত করে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে; একজন বিবেকসম্পন্ন ছাত্র কী করে শিক্ষকের গায়ে হাত তোলে? শিক্ষক যদি কোন অপরাধ করে থাকে (সে ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থা রয়েছে) তাহলেও তাকে কোনভাবেই ছাত্র কর্তৃক অপহৃত বা মারধর করা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা কিন্তু ২/৩ জন শিক্ষককে অপমান করা নয় পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার উপর হাত তোলা।
ময়মনসিংহের ত্রিশালে ১৪ নভেম্বরের ঘটনা; ৮ম শ্রেণির ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার কারণে শিক্ষক আবুল মুনসুর প্রতিবাদ করায় বাড়ি ফেরার সময় বখাটেরা গাড়ি থামিয়ে মারত্মকভাবে জখম করে শিক্ষককে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় শিক্ষককে লাঞ্চিত হতে হয়েছে, সামাজিক অবক্ষয়ের স্খলন কোন পর্যায়ে পৌঁছালে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেও একজন নিরীহ শিক্ষককে অপরাধের শিকার হতে হয়। এহেন অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় দেখা যাবে শিক্ষকতার মহান ব্রত নিয়ে কেউ আর পড়াতে আসবে না। চোখের সামনে অন্যায় দেখেও প্রতিবাদ করার ভাষা হারিয়ে ফেলবে প্রতিবাদীগণ তথা সমাজের বিবেক।আর যারা শিক্ষকদের অপমান অপদস্থ করছে তারাও কিন্তু আমাদের সমাজেরই অংশ। সুতরাং তাদেরকে সংশোধনের জন্য ভিন্ন দেশ থেকে কেউ এসে আমাদের ফর্মুলা দিয়ে যাবে না। সংশোধন করার চেষ্টা করতে হবে তা না হলে ডিটারেন্স থিউরি প্রয়োগ করে অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করতে হবে অপরাধীদের।
আরেকটি সাম্প্রতিক ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইবিএ’র শিক্ষক অধ্যাপক হাছানাত আলী তারই তত্ত্বাবধানে থাকা গবেষক ছাত্রের দ্বারা প্রহারের শিকার হয়েছেন। ছাত্রের অভিযোগ শিক্ষক তাকে সময় দিয়েও সাক্ষাত দিচ্ছেন না, আবার অন্য ব্যাচের ছাত্রদের ক্লাস থাকায় হাছানাত আলী ছাত্রের থিসিস পেপার দেখে দিতে পারেননি বরাদ্দকৃত সময়ে। তাই গবেষক ছাত্র বিভাগেই শিক্ষককে প্রহার করেন। এ কেমন গবেষক? যার কোন ধৈর্য নাই তিনি গবেষণা করতে যান কেন? কারণ একজন শিক্ষক কেবল একজন ছাত্রকেই সময় দেন নাই। তিনি যেমন একাডেমিক কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন তেমনি প্রশাসনিক কাজের সাথে ও জড়িত থাকেন। অধ্যাপক স্যারদের যেমন পিএইচডি, এমফিলের ছাত্র-ছাত্রী থাকেন ঠিক তেমনি অনার্স মাস্টার্স পর্যায়ের গবেষণার ছাত্র-ছাত্রী ও থাকেন। পাশাপাশি বিভিন্ন বর্ষে পাঠদান করে থাকেন, আবার অনেক সময় অন্য বিভাগেও ক্লাস নিতে দেখা যায় শিক্ষকদের। সুতরাং কোন ছাত্র সহসাই হুট করে গেলেন আর শিক্ষকের নিকট সময় পাবেন ব্যাপারটা বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে খুব মানানসই নয়। কিন্তু শিক্ষকের উপর হাত দিয়ে বসলেন, এ কেমন বর্বরতা। পূর্বে ছাত্র-ছাত্রীরা বেয়াদবী করতেন শিক্ষকদের সাথে এমন অনেক নিউজ পত্রিকায় আসতো কিন্তু তখন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারায় এখন হাত পর্যন্ত উঠছে শিক্ষকদের গায়ে। এ ধরনের গর্হিত কাজ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
উপরোক্ত ঘটনাগুলো কিছুদিনের মধ্যে ঘটেছে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে। এমনো অনেক জায়গায় হয়তো শিক্ষকেরা অপমানিত হচ্ছেন কিন্তু পত্রিকার নিউজ কভারে আসছে না। কিন্তু ঘৃণিত কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। এসব কিসের আলামত, কেন এমনটা হচ্ছে, শিক্ষকদের ব্যর্থতা কোথায়, সমাজের ভূমিকাহীনতা কিংবা দায়িত্বহীনতা যাই বলি না কেন বিপর্যয় শুরু হয়ে গেছে। দেখা দিচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়, বেড়ে যাচ্ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে সচেতন অভিভাবকদের মধ্যে। সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সময় থাকতেই ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়ছে, অন্যথায় ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে বাঁচতে হবে বিবেকবানদের।
এ সকল বিষয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কি হতে পারে? শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মাঝে মধ্যেই জনমনে হতাশা দেখা যায়। এ ধরনের বিভ্রান্তি দূর করতে সরকারের পক্ষ হতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জনমনে আস্থা ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও মাঝে মধ্যে পত্রিকায় লিড নিউজ আসছে। শিক্ষকতায় পেশায় কারা আসছে? কাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে? নিয়োগ কি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হচ্ছে? ফিনল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরে সব থেকে যোগ্যদের শিক্ষকতায় পেশায় নিয়োগ দেওয়া হয়। আমরা কি পেরেছি আমাদের মেধাবীদের শিক্ষকতার সাথে যুক্ত করতে? সে ক্ষেত্রে আমাদের নানামুখী সমস্যা রয়েছে। সেগুলো যতদ্রুত সম্ভব দূর করে শিক্ষক, শিক্ষাব্যবস্থা এবং তৎসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)