চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

শাহনাজ রহমতউল্লাহ: সুরে, স্মৃতিতে এবং হ্নদয়ে

১৯৯৮ সালের কথা। তখন আমি তাসমিমা হোসেন সম্পাদিত দেশের অন্যতম সেরা পাক্ষিক ‘অনন্যা’র ফিচার সাংবাদিক। অনন্যা’র প্রতিটি সংখ্যায় খেলা এবং সঙ্গীত বিষয়ক লেখার দায়িত্ব ছিল অনেকটাই আমার এবং সেটা নির্বাহী সম্পাদক দিল মনোয়ারা মনু আপার আন্তরিকতার কারণেই। সে বছর রোজার ঈদ এগিয়ে এলে তাসমিমা ভাবী (উনাকে আমরা ভাবী বলে সম্বোধন করতাম) এবং মনু আপা আমাকে ডেকে বলেন, দেশের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহকে নিয়ে ইন্টারভিউসহ একটা বড় লেখা লিখতে হবে যেটা ঈদ সংখ্যায় ছাপা হবে। এরকম একটা অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে খানিকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। তার উপর আবার শাহনাজ রহমতউল্লাহর মতো একজন গুণী শিল্পীর মুখোমুখি হতে হবে। দ্রুতই শাহনাজ রহমতউল্লাহর বাসার ফোন নাম্বার জোগাড় করে ফেললাম। তখন মোবাইলের যুগের ঘটেনি। মনু আপা শুধু বললেন, ‘নানা কারণে নায়ক সালমান শাহর মৃত্যুর পর শাহনাজ রহমতউল্লাহ সেভাবে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে চান না। সবাইকে এড়িয়ে চলেন। দেখি তুমি ইন্টারভিউটা করতে পার কিনা।’

তখন আমি মিরপুরের কাজীপাড়াতে বড় ভাইয়ের বাসায় থাকি। কলেজ শিক্ষক বড় ভাইয়ের বাসায় একটা টিএন্ডটি ফোন ছিল। একদিন ঐ ফোন নাম্বার থেকে শাহনাজ আপাকে ফোন করে বিনয়ের সাথে আমার ফোন করার উদ্দেশ্য বলি। প্রথম প্রথম তিনি সবকিছু এড়িয়ে যেতে চাইলেন। বারবার বলতে থাকলেন তাঁর অনেক ব্যস্ততা। সেভাবে কথা বলার সময় নেই। আমি ‘অনন্যা’ পত্রিকা আর তাসমিমা ভাবীর রেফারেন্স দিয়ে জোরাজুরি করতে থাকি। একসময় উনি ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্যে রাজি হলেন এবং পরেরদিন বিকেলে বনানীস্থ ডিওএইচএস বাসায় যাওয়ার কথা বললেন এবং ঠিকানা দিলেন। পরের দিন ঠিক সময়ে আমি আর ফটোগ্রাফার বিশ্বজিত বেবি টেক্সিতে চড়ে শাহনাজ আপার বাসায় হাজির হলাম। বাসার গেটে পৌঁছে বারবার ভাবছি আপা বাসায় আছেন কিনা। না থাকলে ঝামেলায় পড়তে হবে।

আপার বাসা নীচতলায়। কলিং বেলে টিপ দিয়ে আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর এক ভদ্রলোক এলেন। কলাপসিবল গেটের ওপারে দাঁড়িয়ে পরিচয় জানতে চাইলেন। সবিনয়ে পরিচয় দিয়ে আমাদের আসার কথা বললাম। এবার উনি ভেতরে গেলেন এবং শাহনাজ আপাসহ বেরিয়ে এলেন। আপাকে বললাম আমাদের অ্যাপয়ন্টমেন্টের কথা। শাহনাজ রহমতউল্লাহ আমাদেরকে বললেন, না এরকম কারো অ্যাপয়ন্টমেন্ট তিনি দেননি। একটু পরেই তিনি বাইরে যাবেন। কথা বলার কোনো সময় নেই। আমি আর ফটোগ্রাফার বিশ্বজিত দুজনেই হতাশ। একী উনি সব ভুলে গেলেন! এবার বাসার ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, উনি মেজর (অব.) রহমত উল্লাহ, শাহনাজ আপার স্বামী। উনি আমাদেরকে ভেতরে নিয়ে বসালেন এবং বললেন, দেখি আমি শাহনাজকে ম্যানেজ করছি। ও সব কথা ইদানীং ভুলে যায়। কিছুক্ষণ পর ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে দিতে শাহনাজ আপা আবার ব্যস্ততা দেখিয়ে বললেন, হাতে একদম সময় নেই বাইরে যাবেন। আমরা দুজন নির্বাক। কীভাবে উনাকে ম্যানেজ করবো ভেবে পাচ্ছি না। এবার রহমত উল্লাহ সাহেব শাহনাজ আপাকে বুঝিয়ে বললেন আমাদের সাথে একটু কথা বলার জন্য। উনি ম্যানেজ হলেন এবং বললেন দশমিনিটের বেশি সময় দিতে পারবেন না। এ কথা শুনে মনে মনে কৌশল আঁটতে থাকলাম আপা ইন্টারভিউ দিতে বসলে এমন সব প্রশ্ন করবো যাতে তিনি দ্রুত উঠতে না পারেন। এর মধ্যে ঠিক করলাম সূচনাতেই তাঁর প্রিয় ভাই প্রয়াত জাফর ইকবালকে নিয়ে একটি প্রশ্ন করবো। সেসময় জাফর ইকবালের কবরটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর বেরোয়। সাংস্কৃতিক কর্মীরা এ বিষয়টির প্রতিবাদ করতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর বাংলা গানের প্রখ্যাত শিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ আমার পাশেই সোফাতে বসলেন। আমি এ গল্প ও গল্পের সূচনা করেই জাফর ইকবালের কবর ভাঙার বিষয়টি উত্থাপন করলাম। বাংলা সিনেমার চিরসবুজ নায়ক খ্যাত জাফর ইকবাল ৯২ সালের ৮ জানুয়ারি প্রয়াত হয়েছেন। তার কবর কেন রক্ষা করা হচ্ছে না এ প্রসঙ্গ তুলতেই শাহনাজ রহমত উল্লাহ ভীষণরকম আবেগআপ্লুত হয়ে পড়লেন। একটি দুটি লাইন কথা বলার পর প্রিয় ভাইকে স্মরণ করে হুঁ হুঁ কেঁদে ফেললেন। শুরু হলো আমাদের কথা বলার পালা। দশমিনিট পেরিয়ে একঘণ্টা পেরিয়ে গেছে শাহনাজ রহমতউল্লাহ আর একবারও বলছেন না তাঁর ভীষণ ব্যস্ততা আছে তিনি আর কথা বলবেন না। ইন্টারভিউ শেষ করে আমরা আপার সাথে ছবিও তুললাম। এরপর ফিরে এলাম বাসাতে।

কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহর উপর লেখাটি সমৃদ্ধশালী করার জন্য এবার গেলাম বেতার ভবনে। বেতার ভবন থেকে প্রকাশিত কয়েকটি পুরনো ‘বেতার বার্তা’ পত্রিকা সংগ্রহ করলাম, যেখানে শাহনাজ রহমতউল্লাহর উপর কিছু তথ্য রয়েছে। কেউ একজন বললেন, বেতারের একটি সংকলন আছে যেখানে কোন গান কত সালে রেকর্ড হয়েছে সেই তথ্যও দেওয়া হয়েছে। এই সংকলনটির খোঁজে স্বনামধন্য গীতিকার জীবন চৌধুরীর দ্বারস্থ হলাম। উনি সেই সংকলনটি দিলেন। সবকিছু ঘেঁটে অনন্যা ঈদ সংখ্যার জন্য লেখাটি তৈরি করলাম। লেখাটি যত্নের সাথে ছাপা হলো। আমি ফোনে মেজর (অর.) রহমত উল্লাহকে বললাম তিনি যেনো গুলশান বা বনানীর কোনো আউটলেট থেকে একটি কপি সংগ্রহ করেন। পরে অনন্যা অফিস থেকে আমরা কপি পাঠিয়ে দিব।

কয়েকদিন পরের ঘটনা। বাসায় গিয়ে শুনি শাহনাজ রহমত উল্লাহ নামের একজন বাসার টিএন্ডটি নাম্বারে ফোন করে আমাকে খুুঁজেছেন। বলেছেন আমি যেনো ফোন ব্যাক করি। আমার আর ফোন করা হয়নি। তিনি আবার ফোন করেন মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে অনন্যা অফিসে, কিন্তু আমাকে পান না। বেশ কিছুদিন পর এবার তাঁকে আমি ফোন করি। আমার ফোন পেয়ে তিনি আবেগআপ্লুত কণ্ঠে বলেন, আমার লেখাটি তাঁর ভীষণ পছন্দ হয়েছে। এত তথ্যসমৃদ্ধ লেখা তাঁকে নিয়ে এর আগে কেউ লেখেনি। আমি অবশ্যই যেনো তাঁর বাসাতে আবার যায়। বোন হিসেবে ছোট ভাইয়ের জন্য তিনি একটা গিফট কিনে রেখেছেন-আমি যেনো সেটি নিয়ে আসি। আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম কোনো একদিন আসবো। তবে গিফট নয় আপা আপনার গান শুনতে। না আর কোনোদিন যাওয়া হয়নি এই অসামান্য শিল্পীর বাসায়, গিফটও নেওয়া হয়নি। শাহনাজ আপাকে যখনই মনে পড়েছে তখনই ইউটিউবে গিয়ে তাঁর গানগুলো খুঁজে মনোমুগ্ধ হয়ে শুনেছি। আজ সকালে জানলাম তিনি আর বেঁচে নেই। চলে গেছেন পরপারে। তবে মানুষের জন্য রেখে গেছেন অসংখ্য মনোমুগ্ধকর গান।

শাহনাজ আপার গানের সাথে কৈশরেই পরিচয় হয় রেডিও আর এলপির (লং প্লে) কারণেই। ষাট-সত্তর ও আশির দশকে গ্রামাঞ্চলে বিয়ে ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে মাইক বাজানোর চল ছিল। তখন বিয়ে বাড়িতে ‘কত যে মিনতি’ সিনেমার লংপ্লে শোনা যেত। এই ছবিতে গাওয়া ‘আমার প্রিয়ের দেশে যারে পাখি যা, উড়ে যা’-এই গানটি এবং বাবলু ছবির সেই মিষ্টি গান ‘আমার ছোট্ট ভাইটি, মায়ায় ভরা মুখটি’ আমাদের হ্নদয় ছুয়ে যেত। এরপর মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীতে ওরা ১১ জন ছবিতে তাঁর গাওয়া গান ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে, বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’ একটি ইতিহাসকেই যেনো জয় করে ফেলে।

সঙ্গীত জীবনে শাহনাজ রহমতউল্লাহ যা গেয়েছেন তাই অমরত্ব লাভ করেছে। আধুনিক, দেশাত্মবোধক এবং সিনেমা-সবখানেই তাঁর গাওয়া গান জনপ্রিয় এবং শ্রোতা কর্তৃক সমাদৃত হয়েছে। গান নির্বাচন ও গাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই চুজি ছিলেন। কখনই চটুল কোনো গান করেননি। বিবিসির সর্বকালের সেরা গানের জরীপে তাই তাঁর গাওয়া চারটি গান ঠাঁই পেয়েছিল। প্রয়াত সুরকার খান আতা, আপন বড় ভাই আনোয়ার পারভেজ, আলাউদ্দিন আলী, সমর দাস, আব্দুল আহাদ, আজাদ রহমান-এর সুরেই বেশি গান করেছেন তিনি। গজলেও তাঁর খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। মেহেদী হাসানের যোগ্য শিষ্য তিনি। তাঁর মতো শুদ্ধ করে বাংলাদেশে অন্য কেউ গজল পরিবেশন করতে পারেন না।

আধুনিক গানের মধ্যে তাঁর গাওয়া অনিন্দ্য সুন্দর গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘তোমার আগুনে পোড়ানো এ দুটি চোখ’, ‘আমায় কেন মুক্ত হতে বল’, ‘আবার কখন কখন কবে দেখা হবে বলো’, ‘আমি তো আমার গল্প বলেছি, ‘খোলা জানালায়, চেয়ে দেখি তুমি আসছো’, ‘আমায় তুমি ডাক দিলে কে’, ‘মানিক সেতো মানিক নয়, ‘সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে’, ‘যদি চোখের দৃষ্টি দিয়ে চোখ বাঁধা যায়,’ ‘মন যারে কাছে পেতে চায়’, ‘এমন মধুর নিঝুম রাতে’, ‘বাঁশিতে রেখেছি মন’, ‘স্বপ্নের চেয়ে সুন্দর কিছু নেই’, ‘আরও কিছু দাওনা দুঃখ আমার’, ‘বুকের অথৈ নদী দেখতে তুমি যদি বুঝতে’, ‘বন্ধন ছিঁড়ে ফেল না’, ‘ঐ আকাশ ঘিরে সন্ধ্যা নামে’, ‘আর নেমনা অথৈ জলে সই’,‘ সাগরের সৈকতে কী যেন দূর হতে আমারি ডেকে ডেকে যায়,’ ‘বন্ধুরে তোর মন পাইলাম না’, ‘ আবার কখন কবে দেখা হবে বল’। তাঁর গাওয়া দেশাত্মবোধক গানের জুড়ি মেলা ভার। সেই স্বাধীনতার আগে থেকে গাওয়া ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে আমায় বল’, ‘একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গাঁও’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার জীবন বাংলাদেশ’, ‘আমারও দেশের মাটিরও গন্ধে’-সহ আরও অনেক গান গেয়েছেন।

দেশের অন্যতম দুই সেরা কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা বা সাবিনা ইয়াসমিনের মতো তিনি অসংখ্য প্লেব্যাক করেননি সত্য। কিন্তু যেগুলো তিনি গেয়েছেন সুরে-লালিত্যে তা অনবদ্য হয়ে আছে। ‘আবার বনবাসে রুপবান’, ‘ওরা এগারোজন’, ‘পিচ ঢালা পথ’, ‘আঁকাবাঁকা’, ‘বিনিময়’ ‘সাক্ষী’, ‘বাবলু’, ছবিসহ আরও অনেক ছবিতে তিনি প্লেব্যাক করেছেন। দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছেন মাহমুদুন নবী, আব্দুল জব্বার, খোন্দকার ফারুক আহমেদ-এর সাথে। ছায়াছবিতে তাঁর গাওয়া গানগুলো এতোটাই সুরসমৃদ্ধ যে এখনও গানগুলো শুনলে সেই অতীতে দ্রুত টেনে নিয়ে যায়। ‘তুমি সাত সাগরের ওপার হতে আমায় ডেকেছ’, ‘আমিতো কেবল বলেই চলি তুমিতো কিছুই বলো না,’ ‘দুটি আঁখি দুটি তারা’, ‘ও যার চোখ নাই, তার চোখের জলের কিইবা আছে’, ‘অনুরাগের গানে গানে আরও কাছে এলে যদি, ‘ দেখা নয়, দেখা হলো’, ‘মন যদি চায় হারিয়ে’, ‘তুমি আমায় দিও উপহার’, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’, ‘পারি না ভুলে যেতে স্মৃতিরা মালা গাঁথে, -এসব গানের আবেদন একবিন্দু কমেনি। সোনালী যুগে শাহনাজ রহমত উল্লাহর গাওয়া এ গানগুলো এখনও যেনো সুরের স্বর্ণে মোড়ানো রয়েছে।

শাহনাজ রহমতউল্লাহ চলে গেলেও কণ্ঠের মহনীয় সুরের সুরভী তিনি রেখে গেছেন। ‘খোলা জানালায়, চেয়ে দেখি তুমি আসছো’- না তিনি আর আসবেন না, কখনই।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)