১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ যখন বিজয়ের ৪৫তম বার্ষিকী উদযাপন করছিল তখন পাকিস্তানেও কয়েকটি অনুষ্ঠান হয়েছে। এমনকি একাত্তরে পাকিস্তানীদের কেউ কেউ এ ভূ-খণ্ডে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদ করলেও পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত গতকালের এসব কর্মসূচিতে সেরকম কোন বক্তব্য ছিল না। কোথাও কোথাও বক্তব্যে তৎকালীন পাকিস্তানের সেনা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কিছু সমালোচনা হলেও সমালোচনার মূল টার্গেট ছিল বাংলাদেশ এবং ভারত, বিশেষ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। হাস্যকরভাবে তাদের বক্তব্যটা এরকম যে, ওই দু’জন মিলে তাদের সাধের পাকিস্তান ভেঙ্গে ফেলেছেন। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্মের ৪৫ বছর পর পাকিস্তানীরা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে না পারলেও বাংলাদেশকে যে তারা মেনে নিতে পারছে না সেটা বাংলাদেশের বিজয় দিবসকে সামনে রেখে তাদের বক্তব্য এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত লেখা থেকে আবারও স্পষ্ট হয়েছে। একাত্তরের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা দুঃখ প্রকাশতো দূরের কথা, এবার তারা বরং বাংলাদেশ বিরোধী নতুন একটি প্রচারণা শুরুর কথা জানিয়েছে। পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডন’-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বিজয় দিবসের দিন করাচীতে একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হয়েছে। ড. জুনায়েদ আহমাদ লিখিত বইয়ের নাম `ক্রিয়েশন অফ বাংলাদেশ: মিথস এক্সপ্লোডেড’ থেকেই বইটি সম্পর্কে প্রাথমিক একটি ধারণা পাওয়া যায়। আর প্রকাশনা উৎসবে পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের যে অংশ বক্তৃতা করেছেন সেখানে তারা তাদের সেনাদের দ্বারা পরিচালিত হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি-সংযোগ এবং লুটপাটের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে টুঁ শব্দটি উচ্চারণ না করে একাত্তরে ‘আসলে কতো মানুষ’ নিহত হয়েছেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা যে তাদের ভাষায় বিশ্ববাসীকে ‘সত্য ঘটনা’ জানাতে পারেননি সেটা নিয়েও আত্মসমালোচনা করেছেন। তারা বলেছেন, একাত্তর নিয়ে বিশ্ব এতোদিন শুধু বাংলাদেশ এবং ভারতের বর্ণনায় ‘আখ্যান’ শুনেছে যা বিভিন্ন মিথের জন্ম দিয়েছে। তাই জুনায়েদ আহমাদের লেখা `ক্রিয়েশন অফ বাংলাদেশ: মিথস এক্সপ্লোডেড’ বইটির প্রশংসা করে তারা একাত্তরে নিহত মানুষের ‘প্রকৃত সংখ্যা’ নিয়ে পাকিস্তানের সরকার এবং সুশীল সমাজকে জোরেশোরে প্রচারণা শুরুর তাগিদ দিয়েছেন। আমরা বইটি এখনো পড়তে পারিনি বলে অসত্যের বিস্তারিত জানতে পারছি না। তবে, প্রকাশনা উৎসবে বক্তাদের বক্তব্য থেকে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাসকে তারা শুধু ‘মিথ’ এবং বাংলাদেশ ও ভারতের ‘আখ্যান’ বলতে চায়। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে চায় তারা। একাত্তরে শহীদ মানুষের সংখ্যা যে ৩০ লাখ সেটা নিজের অপরাধ ঢাকতে পাকিস্তান প্রত্যাখ্যান করতেই পারে, কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ করা জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের নেতারা ছাড়া এদেশের কারো কখনও শহীদের সংখ্যা নিয়ে কোন দ্বিমত ছিল না। অন্ততঃ প্রকাশ্যে কেউ বিতর্ক করার সাহস পায়নি। এ নিয়ে দেশের ভেতরে উচ্চ পর্যায় থেকে প্রথম প্রশ্ন তোলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার ওই বক্তব্যের পর পাকিস্তানী এক কথিত গবেষক তার বইয়ে শহীদের সংখ্যাসহ মুক্তিযুদ্ধের অনেক বিষয়কে ‘গল্প-গুজব’ বলেছেন। আমরা বিশ্বাস করতে চাই না যে, খালেদা জিয়ার বক্তব্য এবং `ক্রিয়েশন অফ বাংলাদেশ: মিথস এক্সপ্লোডেড’-এর মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে। আমরা এও বিশ্বাস করতে চাই না যে, খালেদা জিয়ার বক্তব্য এবং পাকিস্তানীদের নতুন ‘ক্যাম্পেইন’-এর মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে। তবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী যখন মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তোলেন, সেটা পাকিস্তানের পক্ষে যায় বলে পাকিস্তানীরা তা লুফে নিয়েছে।