শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘ম্যাডোনা-৪৩’ এর কথা আমাদের অনেকেরই মনে আছে। একজন জীর্ণ মধ্যবয়সী নারী, যিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন। আশেপাশে ছিল অনেক খাবারের উচ্ছিষ্ট, খাদ্যের অভাবে মুখে বিষন্নতার ছাপ। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের পটভূমিতে অংকিত শিল্পাচার্যের দূর্ভিক্ষ সিরিজের কয়েকটি চিত্রকর্মে তৎকালীন মহামারির ভয়াবহতা আমরা খুব ভালোভাবেই দেখতে পাই। যার মূল কারণ ছিল ব্রিটিশ সরকারের অবর্ণনীয় শোষণ।
ঠিক তেমনই ১৯৭১ এর আগ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকশ্রেণী ২৩ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের কাছ থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা শোষণ করে। যার পুরোটাই ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের কৃষিখাতের অর্জিত সম্পদ। জাতির পিতার কণ্ঠেও এটি উচ্চারিত হয়েছে অনেকবার- ‘এ বাংলা থেকে ২৩ বছরে ৩ হাজার কোটি টাকা পশ্চিমারা আমার কৃষকের কাছ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেছে।’ যারপরনাই শোষিত একটা দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ বাধিয়ে, নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে, দেশের আবাদি ভূমি শ্মশান বানিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার হয়তো ভেবেছিল- বাংলাদেশের মেরুদণ্ড তারা খুব ভালোভাবেই ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু তারা হয়তো কল্পনাও করেনি এদেশ একজন মহান নেতার দেশ, যিনি দূরদর্শিতার এক অনন্য উদাহরণ।
তিনি ১৯৫৪ সালের তৎকালীন পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি, পরিবেশ ও সমবায় মন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর অনুধাবন করেছিলেন কৃষি ছাড়া এদেশের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি বাংলাদেশের আপামর জনতার রাখাল রাজা, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অর্থনীতির সুগঠিত কাঠামো গড়তে কৃষিখাতে উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাইতো তিনি ১৯৭২-৭৩ সালের উন্নয়ন বাজেটে পাঁচশত কোটি টাকার মধ্যে একশত এক কোটি টাকা কৃষি সেক্টরে বরাদ্দ করেছিলেন, যেটি বঙ্গবন্ধুর কৃষিবান্ধব নীতির কারণেই সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর কৃষিনীতি ও তার কৃষি বিষয়ক দর্শন ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তার স্বল্পকালীন শাসনামলে কৃষি উন্নয়নে যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন এসবের মধ্যে অন্যতম ছিল ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি প্রায় ২২ লাখ কৃষকের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। তাদের মাঝে মানসম্মত বীজ, সার, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ বিনামূল্যে ও নামমাত্র মূল্যে সরবরাহ করেন। তিনি প্রান্তিক কৃষকদের বিরুদ্ধে করা সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও ভূমিহীনদের মাঝে সরকারি খাস জমি বন্টন করে দেন। বিশ্বে আজ বাংলাদেশ কৃষি সেক্টরে একটা রোল মডেলের নাম। সেই মডেলের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কৃষক ভাইদের প্রতি আমার অনুরোধ কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে সবুজ বিপ্লব সফল করে তুলুন। বাংলাদেশকে খাদ্যে আত্মনির্ভর করে তুলুন’ (২৯ অক্টোবর, ১৯৭৩)।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ও অনুকরণীয় অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘জাতীয় কৃষি পুরষ্কার’ প্রবর্তন করেন। যা বর্তমানে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরষ্কার’ নামে পরিচিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ব্যবহারিক কৃষি ও কৃষিশিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন এ দেশের কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, খাদ্য ঘাটতি পূরণ ও অধিক পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের জন্যে দেশের কৃষিবিদদের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। মেধাবীরা যে বিষয়েই জ্ঞান অর্জন করুক না কেন, সে বিষয়ে তার দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। অতএব কৃষিবিদদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে কৃষি শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াসে তিনি ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃষি বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার পদমর্যাদা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি তোদের পদমর্যাদা দিলাম, তোরা আমার মান রাখিস’।
ফলে কৃষি শিক্ষায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রবেশ বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের বেতন কাঠামোয় কৃষিবিদদের সেই মর্যাদা আবারও একধাপ নামিয়ে দেয়া হয়। কৃষিবিদদের তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সরকার কৃষিবিদদের সেই হারানো সম্মান আবার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ফলে বঙ্গবন্ধুর কারণে আজকে আমরা কৃষিবিদরা গর্ব করে বলতে পারি, ‘বঙ্গবন্ধুর অবদান, কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান’।
কৃতজ্ঞতাস্বরুপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে দেশের কৃষিবিদদের অবদান শুধুমাত্র একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হওয়ার কথা। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ২ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে পরবর্তী এক যুগে জমির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১৪ লক্ষ হেক্টর আর খাবারের মুখ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় দশ কোটি। অথচ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্যের পরিমাণ দাড়িয়েছে প্রায় ৪ কোটি ৩২ লাখ ১১ হাজার মেট্রিক টন। যা নির্ধারিত লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতিনিয়ত দেশের কৃষিখাতে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাচ্ছে আর দেশ পরিণত হচ্ছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক সোনার বাংলায়। যেমনটি বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন- ‘নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা। বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে। বাংলার মানুষ পেট ভরে খাবে। এই আমার জীবনের সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য’!
শুরুটা করেছিলাম একটি চিত্রকর্মের গল্প থেকে, শেষও করব একটি ভিন্নধর্মী চিত্রশিল্প দিয়ে। এখানে তুলি হল সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষাদের হাত, রং হলো দেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান, আর ক্যানভাস হলো সোনার বাংলাদেশের সবুজ মাঠ। সেই তুলি, রং আর ক্যানভাসে অঙ্কিত হচ্ছে জাতির পিতার শস্যচিত্র। বগুড়া জেলার শেরপুরের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের বালেন্দা গ্রামে কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাসিমের সভাপতিত্বে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদ’ এর উদ্যোগে ও ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ারের সহযোগিতায় ১২০ বিঘা জমির উপর ব্যতিক্রমী এই কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।
মুজিববর্ষের শরুতেই এই সুবিশাল কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদ। প্রায় ৫ মাস পূর্বে চীন থেকে সবুজ ও বেগুনী রংএর হাইব্রিড ধানের জাত আমদানী করা হয়। এরপর বীজতলা তৈরী, চারা উৎপাদন এবং অতি সম্প্রতি ২৯ জানুয়ারী, ২০২১ চারা রোপনের মাধ্যমে উদ্ভোধন করা হয় এই মহৎ কর্মযজ্ঞের। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ কয়েকজন কৃষিবিদ। বাংলাদেশ কৃষকলীগের সভাপতি কৃষিবিদ সমীর চন্দ, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম মাহবুবুল হাসান মাহবুবসহ আরও অনেকে।
রেকর্ড অনুযায়ী ২০১৯ সালে চীন ৮ লাখ ৫৫ হাজার ৭৮৬ বর্গফুট একটি শস্যচিত্র তৈরি করেছিল। আর বাংলাদেশের এই নন্দনিক শস্যচিত্রটির আয়তন সেটার চেয়ে প্রায় দেড় গুণ অর্থাৎ ১২ লাখ ৯২ হাজার বর্গফুট। সব শর্ত মেনে কাজটি শেষ করা হলে তা হবে গিনেস বুকের ‘লার্জেস্ট ক্রপ ফিল্ড মোজাইক (ইমেজ)’ শাখার নতুন বিশ্বরেকর্ড। গোটাবিশ্বের এই সর্ববৃহৎ শস্যচিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর নাম গিনেস ওয়াল্ড রেকর্ডস এ ঠাই নিবে আর অর্জিত হবে বাংলাদেশে একটি নতুন ইতিহাস। যা হবে মুজিববর্ষের একটি অন্যতম সেরা অর্জন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)