ডেভিড বার্গম্যানের The Wire-এ লেখা একটা ইংরেজী রিপোর্ট
(http://goo.gl/CHYf2e) বাংলাদেশের স্বনামধন্য বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
ফেইসবুকে শেয়ার দিচ্ছেন বেশ প্রত্যয় নিয়ে, যাকে অপপ্রচার বলা হলেও
অত্যুক্তি করা হবে না। এরা বিভিন্নভাবে প্রমাণিত ডেভিড বার্গম্যানের গোপন
সমর্থক এবং তার আকাঙ্খার প্রবর্তক ও পরিচালক।
বার্গম্যান কিছুদিন আগে নিউইয়র্ক টাইমসের উপসম্পাদকীয়তে একাত্তরের শহীদের সংখ্যা নিয়ে আপত্তিকর লেখা লিখেছিলেন এবং এর আগে একই কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত অবমাননা করার জন্য তিনি সাজাপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন।
The Wire-এর রিপোর্টে ডেভিড বার্গম্যানের দাবির মূল মাজেযা হচ্ছে, মামলায় ইউএস ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট শুনানিতে শফিক রেহমানের নাম উচ্চারণ না করে শুধু ‘একজন সাংবাদিক’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন এবং শুনানির এক পর্যায়ে মূল মামলা থেকে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি খারিজ করে দিয়েছিলেন।
এমনকি, মামলায় যাদের অভিযুক্ত ও সাজা দেয়া হয়েছিলো, তারও কারণ বর্ননা করেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান তার রিপোর্টে। তবে সাংবাদিক বার্গম্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের একজন Peter Carr-কে সজীব ওয়াজেদ জয় সংশ্লিষ্ট ঘটনায় শফিক রেহমানের গ্রেফতারের বিষয়ে মন্তব্য করতে অনুরোধ করলে তিনি কোন মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। কিন্তু, এর মানে এই না যে তিনি জয়ের দাবি অস্বীকার করেছেন।
মামলাটি হয়েছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে। আসামীদের সাজা দেয়ার পর তারা উচ্চ আদালতে আপিল করেনি বলেই শুনেছি এবং তার কারণ হতে পারে, “কথায় কথা বাড়ে” থিওরিতে উচ্চ আদালতে ‘কেঁচো খুড়তে সাপ’ বেরিয়ে আসার ভয়ে তারা সে পথ মাড়াননি!
অপরাধ যা-ই হোক না কেনো, আমেরিকায় তিনজন আসামীর বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। অর্থাৎ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। যে অপরাধে তিন আমেরিকান নাগরিক (জন্মগতভাবে বাংলাদেশীসহ) সাজাপ্রাপ্ত হলেন, সেই একই পাপে সাংবাদিক শফিক রেহমানের নামটি খারিজ করে দেয়া হলো মার্কিন আদালতে, তার কারণ কি? যারা শেয়ার ও সমর্থন দিচ্ছেন ডেভিড বার্গম্যানের অনুসন্ধানী রিপোর্টটিকে, তাদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন ও যুক্তি উপস্থাপন করছি। দয়া করে ভেবে দেখবেন কি যে, প্রশ্নগুলো এবং বিশ্লেষণগুলো যৌক্তিক কিনা?
১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বসে করা কোনো ষড়যন্ত্রে যদি বিদেশী নাগরিকদের সাথে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সংস্থা জড়িত থাকে এবং সেই ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য যদি হয় তৃতীয় বিশ্বের কোনো একটি দেশের সরকার এবং একই সাথে তা যদি মার্কিনীদের নিরাপত্তা এবং স্বার্থবিরোধী না হয়, তাহলে সেই মামলার মেরিট ও রায় সাধারণত কি রকম হয়?
২) যে ষড়যন্ত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই-এর একটি অংশ জড়িত থাকে, অর্থাৎ সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে, এবং সেই কারণে যদি মামলার রায় হয় এইভাবে যে, ‘অপরাধীরা ওয়াজেদ জয়কে গুম এবং হত্যার পরিকল্পনা করেছিলো’, তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকা বুঝায় কি-না? অর্থাৎ পরোক্ষভাবে হলেও যুক্তরাষ্ট্র ফেঁসে যায় কি-না?
৩) দুই নাম্বারের ঝুকি এড়ানের জন্য আদালত যদি বলে যে, এই ষড়যন্ত্রটি মূলত সজীব ওয়াজেদ জয়কে ভয় দেখাতে করা হয়েছিলো, কিন্তু গুম বা হত্যা করা তাদের উদ্দেশ্য ছিলো না, তাহলে এই রায় আইনের কোন প্যারাগ্রাফ বা ধারা অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য হতো? কেনো এই রায়ের বিরুদ্ধে আমেরিকান স্টেট বা বিবাদী পক্ষ আপিল করলো না?
৪) উপরের ১, ২, ৩ আমলে নিলে এবং যদি ধরে নেই এফবিআইয়ের সংযুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিব্রত, তাহলে তারা বাংলাদেশের সরকারকে বুঝিয়ে তাদের ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেলের মাধ্যমে একটা আপোষ-মীমাংসা করে ফেললে কি তা অবাক হওয়ার কিছু থাকবে?
৫) আপোষ-মীমাংসার মুচলেকা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি শফিক রেহমানের ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণের নথিপত্র বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করে থাকে, যা তাদের বিভিন্ন তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, বিষয়টি কি অযৌক্তিক বা অবিশ্বাস্য হবে?
৬) যেহেতু ষড়যন্ত্রটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে হলেও তা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয় এবং যেহেতু শফিক রেহমানের মতো একজন বিদেশী দ্বৈতনাগরিক যিনি আমেরিকায় বসবাস করেন না বা তখন ছিলেন না, তাকে মামলায় সংযুক্ত করা কি আইনের দৃষ্টিতে যৌক্তিক? উল্লেখ্য যে, শফিক রেহমান একই সাথে বাংলাদেশ এবং বৃটেনের নাগরিক। অর্থাৎ তিনি দ্বৈত নাগরিকের সুবিধা ভোগ করে থাকেন।
৭) শফিক রেহমানকে যদি মামলায় বিবাদি বা আসামী করা হতো, তাহলে মার্কিনীদের বন্ধু বৃটিশরা কি সেটা ভালোভাবে নিত বা বিব্রত হতো না?
৮) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি যৌথ নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশ্নে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হয় এবং বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রের কথা যদি মার্কিনীদের তদন্তে বেরিয়ে আসে যে, বাংলাদেশে অবস্থানকারী একজন বাংলাদেশী নাগরিক সেই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলো, তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র সেই তদন্তের নথিপত্র এবং প্রমাণাদি বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে না বা এটাই স্বাভাবিক নয়?
৯) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট নিশ্চয়ই ‘স্যুভেনিয়র’ হিসেবে মিউজিয়ামে রাখার জন্য নথিপত্রগুলো বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করেনি। তাহলে কি তারা এই ষড়যন্ত্রের ক্রীড়নকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছে?
১০) এখন পর্যন্ত বৃটেন সরকার শফিক রেহমানের গ্রেফতারের বিষয়টি শুধু পর্যবেক্ষণ পর্যায়ে রেখেছে। তারা কোন মন্তব্য বা তাকে কারামুক্ত করার জন্য কোনো চেষ্টা-তদবির করেনি। তাহলে তারাও কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের সাথে একমত পোষণ করে?
গণজাগরন মঞ্চ, বিএনপিসহ জামায়াত ইসলামী শফিক রেহমানের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিএনপি এটাকে সরকার কর্তৃক ‘ভিন্নমত ও বিরোধী দমন’ হিসেবে দেখছে। ডেভিড বার্গম্যানের এই রিপোর্ট এবং রিপোর্টের প্রচার-প্রচারণায় যারা অংশগ্রহণ করছেন, তারাও প্রমাণে ব্যস্ত যে, শফিক রেহমানকে ‘ভিন্নমত এবং বিরোধী দমন’ তত্ত্বেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
এ পর্যায়ে নিঃসন্দেহে দুই পক্ষই তাদের নিজ নিজ দাবির পক্ষে অনড়। সরকারকে হাস্যকর এবং বিতর্কিত করার যত প্রক্রিয়া, তারা তা নিজ দায়িত্বেই করছেন বলে অনুমান করলেও তারা যে যথেষ্ট সংঘবদ্ধ, তা যৌক্তিকভাবেই অনুমান করা যায়। এঅবস্থায় সরকারের পরবর্তি ‘করণীয়’ কি হবে, সেটাই দেখার বিষয়। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে, বিরোধী শিবিরের যাদের দিনের আলোতে দেখা যায়, তাদের চেয়ে আঁধারের চক্রান্তকারীরা অনেক বেশি কৌশুলী এবং অত্যন্ত ভয়ংকর!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)