চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ল্যাপটপ-আইপ্যাড নিষিদ্ধ করার আসল কারণ নিরাপত্তা না, অর্থনৈতিক

উড়োজাহাজে ল্যাপটপ-আইপ্যাড বহনে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ যতটা না নিরাপত্তাঝুঁকি, তার চেয়েও অনেক বেশি উপসাগরীয় এয়ারলাইন্সগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষতি করে মার্কিন বিমান সংস্থাগুলোকে সুবিধা দেয়া। এরকম বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছে খোদ ওয়াশিংটন পোস্ট। তাদের ব্যাখ্যায় স্পষ্ট করা হয়েছে, মার্কিন বিমান সংস্থাগুলোকে সুবিধা দিতেই ট্রাম্প প্রশাসন নতুন নীতি গ্রহণ করেছে।

দশটি মুসলিম প্রধান দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রমুখি ভ্রমণের সময় উড়োজাহাজে স্মার্টফোনের চেয়ে বড় কোন ইলেকট্রনিক ডিভাইস যেমন– আইপ্যাড, ল্যাপটপ ইত্যাদি বহনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

মিশর, জর্ডান, কুয়েত, মরক্কো, কাতার, সৌদি আরব, তুরস্ক অথবা সংযুক্ত আরব আমিরাত—কেউ যদি এই দেশগুলোর একটির নাগরিক হন এবং কেউ যদি ইজিপ্ট এয়ার, এমিরেটস, ইতিহাদ এয়ারওয়েজ, কুয়েত এয়ারওয়েজ, কাতার এয়ারওয়েজ, রয়্যাল এয়ার মরক্কো, রয়্যাল জর্ডানিয়ান এয়ারলাইনস, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস অথবা টার্কিশ এয়ারলাইনে ভ্রমণ করেন তাহলে বিমানে ল্যাপটপ কিংবা আইপ্যাড বহন করতে পারবেন না।

হঠাৎ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনটি কেন করছে? এর পেছনের উদ্দেশ্য আসলে কী?

যুক্তরাষ্ট্র বলছে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাজনিত কারণ
ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে চলাচল করা বিমানগুলোকে লক্ষ্য করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হামলা চালাতে পারে বলে দেশটির গোয়েন্দারা আশঙ্কা করছেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মঙ্গলবার থেকে নতুন এ নিয়ম চালু করা হয়েছে। সিরিয়ার একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে বিশেষ এক ধরণের বোমা তৈরি করছে যা চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। এ বিষয়টি প্রশাসনকে বেশ কিছুদিন ধরে ভাবিয়ে রেখেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের বিশেষজ্ঞরা অবশ্য নতুন নিয়ম চালু করা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের এমন ব্যাখ্যা সম্পর্কে সন্দিহান। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক গোয়েন্দা তথ্য কিংবা দীর্ঘমেয়াদি সচেতনতার অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কি না সেটা প্রশাসন পরিষ্কার করে বলছে না। শুধু হ্যান্ডব্যাগে বহন করা ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে কেন সতর্কতা জারি করা হলো, কিন্তু বিমানের লাগেজে করে যে ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো যাবে সেগুলো কেন সতর্কতার বাইরে থাকবে। এ বিষয়টি তারা বুঝে উঠতে পারছেন না।

একটি বিকল্প ব্যাখ্যা
ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, নতুন এ সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ নিরাপত্তা নাও হতে পারে। ইমেরিটাস, ইতিহাদ এয়ারওয়েজ ও কাতার এয়ারওয়েজ এই তিনটি এয়ারওয়েজকে তালিকাভুক্ত করার পেছনের কারণ:
এগুলোর মার্কিন প্রতিযোগীরা তাদের বিরুদ্ধে নিজ দেশের সরকারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কার্যকরি ভর্তুকি সুবিধা পাওয়ার অভিযোগ করে আসছে। ট্রাম্প তাদের উপর প্রতিশোধমূলক আচরণ করতে পারে এ আশঙ্কা থেকে কয়েকমাস ধরে এয়ারলাইন্সগুলো উদ্বিগ্ন ছিলো। এটা প্রতিশোধও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটের শিকার হওয়ায় এই তিনটি এয়ারলাইন্সসহ বাকি এয়ারলাইনগুলোও ট্রাম্প প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রথম শ্রেণি ও বিজনেস ক্লাস যাত্রীদের হারাতে যাচ্ছে, যা থেকে তারা বিপুল পরিমাণ ব্যবসা করে থাকে।

ব্যবসায়ীরা সাধারণত বিমানের মধ্যে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য ও পছন্দ করে থাকেন। এ কারণে তারা উচ্চমূল্য পরিশোধ করে বিজনেস ক্লাস ও ফার্স্ট ক্লাসে ভ্রমণ করে থাকেন। এ যাত্রীদেরকে এখন থেকে স্মার্টফোনেই কাজ সারতে হবে অথবা তারা ভ্রমণরত অবস্থায় আর কোনো কাজই হয়তো করতে পারবেন না। এ কারণেই তারা উপসাগরীয় এয়ারলাইন্সগুলোতে ভ্রমণ বাদ দেবেন এবং এর পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারলাইন্সে ভ্রমণ শুরু করবেন।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বলেছে, এ নিয়মের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান সরাসরি ফ্লাইটগুলোর পাশাপাশি ফ্লাইটের সাথে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় এয়ারপোর্টসমূহে গড়ে ওঠা ব্যবসায়িক মডেলকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ট্রাম্প প্রশাসনের লক্ষ্যবস্তু হওয়া এই এয়ারলাইন্সগুলোতে শুধু উপসাগরীয় যাত্রীরাই ভ্রমণ করেন না, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এ এয়ারলাইন্সগুলো ব্যবহার করে ভ্রমণ করে থাকেন। এয়ারলাইন্সগুলো তাদের যাত্রীদের বিভিন্ন এয়ারপোর্টে উঠিয়ে-নামিয়ে তাদের যাত্রাসূচি সাজায়। বিপুল সংখ্যক যাত্রী নিয়ে কেন্দ্রীয় এয়াপোর্টগুলোতে গড়ে উঠেছে বিশাল ব্যবসা। এ সিদ্ধান্তের ফলে অর্থনৈতিক মডেলটি ঝুঁকির মুখে পড়লো। যদি এই এয়ারলাইন্সগুলোর যাত্রীদের যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারলাইনগুলো নিয়ে নিতে পারে তাহলে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি করা সম্ভব হবে।

পরস্পরের নির্ভরতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র
আগেও বিষয়টি অনেকবার আলোচনায় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র এর উপর নির্ভরশীল দেশ কিংবা পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। পারস্পরিক নির্ভরতার বিশ্বে  যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের বাইরে পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, যার মাধ্যমে বিপুল মুনাফাও আসছে, কিন্তু সবার ক্ষমতা এখানে সমান নয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু স্থানে বিভিন্ন দেশ বা এর নাগরিকদের বিপুল সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে এবং অনেকের উদ্দেশ্যও অর্জিত হয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে এটি অন্যর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবার ঝুঁকিরও সৃষ্টি করে।এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটি পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই তারা ইচ্ছেমতো তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে।

উপসাগরীয় এয়ারলাইন্সের দুর্বলতা

মুক্ত বাণিজ্যনীতির আবেদনের মাধ্যমে উপসাগরীয় এয়ারলাইন্সগুলো তাদের উপরে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আক্রমণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মুক্ত বাণিজ্যের চুক্তিগুলো যেমন-বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা নির্ধারিত নিয়ম এয়ারলাইন্সের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। যদিও তারা সংশ্লিষ্টখাতগুলোতে এ নিয়ম পালন করার চেষ্টা করে থাকে। যেমন-বিমান তৈরির শিল্প। এতদিন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কোন চিন্তা না করেই উপসাগরীয় এয়ারলাইন্সগুলো বিপুল ভর্তুকি সুবিধা পেয়ে আসছিল। ট্রাম্পের নতুন সিদ্ধান্তের কারণে উপসাগরীয় রাষ্ট্রসহ ক্ষতিগ্রস্ত অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম-নীতির কারণে অসুবিধায় পড়বে। যদি সত্যিকার অর্থেই নিরাপত্তার কারণ বা আত্ম স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে বা প্রতিশোধ নিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকে, তাহলেও সংশ্লিষ্ট দেশগুলো সমস্যায় পড়বে।