রোহিঙ্গা সংকটকে বলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান শরণার্থী সংকট। জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। রোহিঙ্গা নিধনের বিরুদ্ধে কিছু না বলায় শুরু থেকেই সমালোচনার মুখে রয়েছেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী যথাসময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হলেও এই সংকটের বিষয়ে মিয়ানমারের পক্ষে তদারকি করছেন তিনি। তাহলে রোহিঙ্গা সংকটকে অং সান সু চি এখন কীভাবে দেখছেন?
মার্কিন কূটনীতিক বিল রিচার্ডসনের কথায় তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। অং সান সু চির মারমুখী আচরণের কারণে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের গঠিত প্যানেল থেকে সম্প্রতি তিনি পদত্যাগ করেছেন। প্যানেল আলোচনায় সু চির সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন রিচার্ডসন এবং সু চির নেতৃত্বকে নৈতিকতাহীন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
যেই আন্তর্জাতিক প্যানেল থেকে বিল রিচার্ডসন পদত্যাগ করেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সেটি গঠন করেছিলেন অং সান সু চি। বিল রিচার্ডসন রয়টার্সকে বলেন: তিনি যে প্যানেল থেকে পদত্যাগ করেছেন সেটি ‘কৃত্রিম বর্ণের’। আমি এই চিয়ারলিডিং সরকারের দলে থাকতে চাই না।
‘প্যানেল আলোচনায় মিয়ানমারে আটক রয়টার্সের দুই সাংবাদিকের বিষয়ে প্রশ্ন করলে সু চি ক্ষুদ্ধ ও মারমুখী প্রতিক্রিয়া জানান এবং এটা আলোচনার বিষয় নয় বলে মন্তব্য করেন। মিয়ানমার জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মীদের ওপর নিপীড়নের চেষ্টা করছে’, বলেন সাবেক এই মার্কিন মন্ত্রী।
এর আগে গত অক্টোবর বিবিসির মিশাল হুসেইনের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলেন সু চি। তখন রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনের কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন: ভয়ের পরিবেশ থেকেই মূলত এই সহিংসতা। রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চারণে নারাজ সু চি তখন বলেছিলেন, বৌদ্ধরাও সহিংসতার শিকার হয়েছে।
সু চি বলেন: সহিংসতা দমন করতে না পারা সরকারের দুর্দশার ফলাফল। স্বৈরশাসনের ফল এগুলো। আমি মনে করি, যদি আপনি দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরতন্ত্রের অধীনে বসবাস করেন, তাহলে মানুষ একে অপরকে বিশ্বাস করতে চায় না। স্বৈরতন্ত্র অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করে।
এর আগে ২০১৫ সালেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সংকট মোকাবেলার জন্য তাকে আহ্বান জানান। তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামা বলেন, আমি দুইবার সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখতে তার প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। তবে তিনি কিছু অসুবিধার কথা বলেছিলেন, যা স্বাভাবিক নয়, খুব কঠিন বলে জানান সু চি।
তবে নোবেল জয়ের ২০ বছর পর ২০১২ সালে অসলোতে সু চি নোবেল গ্রহণের বক্তব্য দেন। তখন তিনি বলেন: এই সম্মান মিয়ানমারের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর মনযোগ কেড়েছে। মিয়ানমার হচ্ছে বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশ এবং ভবিষ্যতে এই দেশে একমাত্র এক্যৈর শক্তি প্রতিফলিত হবে। আমাদের লক্ষ্য মূলত উচ্ছেদহীন, ঘরহীন এবং আশাহীনতা মুক্ত বিশ্ব গড়া। এমন একটি বিশ্ব হবে যেখানে সব মানুষের শান্তিতে বসবাসের স্বাধীনতা থাকবে।
এগুলো তারই কথা যিনি অনেক বছর ধরে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর কাছে মানবাধিকারের রাণী হিসেবে গণ্য হয়ে আসছেন। ১৯৯০ সালের শুরুর দিক থেকে ২০১০ সালে বন্দীদশা থেকে মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তিনি পুরো বিপরীত চেহারায় আবির্ভূত হন। ঘরহীন মানুষ মুক্ত পৃথিবী গড়ার কথা বললেও তার আমলে রাখাইন থেকে ঘরছাড়া হয় প্রায় ১০ লাখ মানুষ।
তবে সু চি বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলেও তিনিটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়-স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। বাংলাদেশের সঙ্গে সীমানাসহ উত্তর রাখাইন রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে। সুতরাং এসব এলাকায় কোন কিছু করার ক্ষেত্রে সু চির খুব কম নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারে রোহিঙ্গা বিরোধী মনোভাব তুঙ্গে থাকায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে কিছু বললে সু চি বৌদ্ধ নাগরিক এবং সেনাবাহিনীর ক্ষোভের মুখে পড়বেন। এমনকি সাধারণ জনগণের কাছেও তিনি একই পরিস্থিতিতে পড়বেন। কারণ তাদেরও রোহিঙ্গাদের প্রতি কোন সহানুভূতি নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার কিছু না বলার কারণ এখান থেকেও ব্যাখা করা যায়।
কিন্তু তাহলে তিনি মানবতার প্রতীক হিসেবে থাকবেন কী করে? একজন ব্রিটিশ মন্ত্রী বলেন: সত্যি বলতে আমি এই বিষয়ে তার নৈতিক নেতৃত্ব আশা করেছিলাম, কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। বিবিসিও সু চিকে এবং মিয়ানমার সামরিক প্রধানকে প্রতিক্রিয়া দেখাতে বলেছিলেন, কিন্তু তারা কোন জবাব দেননি। এছাড়া সেনাবাহিনীর সমালোচনা না করা এবং জাতিগত নিধনের অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থতার জন্য বিশ্ব নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন সু চির সমালোচনা করে আসছে।
শুধু সমালোচনা নয়, সংকটের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে সু চির ওপর। গত নভেম্বরে সু চিকে দেয়া ‘ফ্রিডম অব দ্য সিটি অব অক্সফোর্ড অ্যাওয়ার্ড’ প্রত্যাহার করা হয়। তার জন্য এই সম্মাননা আর যথোপযুক্ত নয় এমন উদ্ধৃতি দিয়ে সিটি কাউন্সিলে প্রস্তাব পাস করা হয়। মিয়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৭ সালে তাকে এই সম্মাননা জানিয়েছিল যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড সিটি কাউন্সিল।
এছাড়া অং সান সু চিকে দেওয়া আরো বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সম্মাননা প্রত্যাহার করা হলেও রোহিঙ্গা বিরোধী মনোভাবেই অনড় আছেন অং সান সু চি। অথচ ১৯৯০ সাল থেকে তার মুক্তির দাবীতে আন্দোলন করে প্রাণ হারিয়েছিলেন বহু রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা অনেক রোহিঙ্গা এখনও আশা করেন, আগের মতোই অং সান সু চি তাদের পক্ষ নেবেন এবং তার মধ্যস্থতায় তারা আবারও ফিরতে পারবেন নিজ ভূমিতে।