মায়ানমারে আজ প্রায় শতবর্ষ ধরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে জাতিগত বিভেদ চলে আসছে সংখ্যাগুরু বর্মিদের। মায়ানমার সরকারের মতে, রোহিঙ্গারা হল বাঙালি, যারা বর্তমানে অবৈধভাবে মায়ানমারে বসবাস করছে। তবে প্রকৃত ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা মায়ামারে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে।
সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উদ্ভব হয়। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানীদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তীতে চাঁটগাইয়া, রাখাইন, আরাকানী, বর্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের মিশ্রণে উদ্ভুত এই সংকর জাতি ত্রয়োদশ-চর্তুদশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পঞ্চদশ শতাব্দী হতে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানে রোহিঙ্গাদের নিজেদের রাজ্য ছিল।
মায়ানমার সরকারের দাবি, রোহিঙ্গারা হল ভারতীয়, বাঙালি ও চাঁটগাইয়া সেটলার, যাদেরকে ব্রিটিশরা আরাকানে এনেছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রতিষ্ঠত যে, ব্রিটিশরা বার্মায় শাসক হিসেবে আসার কয়েক শতাব্দী আগে হতেই রোহিঙ্গারা আরাকানে পরিষ্কার জাতি হিসেবে বিকশিত হয়েছিল।
এ পর্যন্ত মায়ানমার সরকার ও রাখাইন বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছে নিযুতাধিক।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের বাংলাদেশের নাগরিকরা দ্বিধাবিভক্ত। এক দল বলছে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না; আরেক দল বলছে, বাংলাদেশের উচিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদশে আশ্রয় দেয়া। কিন্তু বাস্তবতা হল, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গা ইস্যুর কোনো সমাধান নয়।
দুর্বল-দরিদ্র অর্থনীতি ও অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে পিষ্ট বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়াটা বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা দুপক্ষের জন্যই ক্ষতিকর। নিপীড়িত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা সহজেই বাংলাদেশের মুসলিম জঙ্গি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বাংলাদেশে অবস্থানরত স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলো এদের জঙ্গি হিসেবে রিক্রুট করে। বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনগুলোর কর্মীদের একটি বড় অংশ রোহিঙ্গা।
এছাড়া, নতুন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে মায়ানমার; কারণ, তখন তাদের রোহিঙ্গাহীন মায়ানমার গড়ার স্বপ্নপূরণ হবে। নতুন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না দেয়া ও বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ হবে সমোয়পযোগী এবং রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্য সুদূরপ্রসারী।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে রোহিঙ্গা, মায়ানমার, বাংলাদেশ, আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় ও সংগঠনের সম্ভাব্য কি কি করণীয় তার একটি তালিকা করা যেতে পারে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে রোহিঙ্গাদের করণীয় যা হতে পারে:
◘ রোহিঙ্গা জাতিকে একটি কার্যকরী পরিষদ গঠন করে, তার অধীন একতা বদ্ধ করা।
◘ সেই কার্যকরী পরিষদের মাধ্যমে আর্ন্তজাতিক মঞ্চে রোহিঙ্গাদের শক্তিশালী প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি করা।
◘ সকল রোহিঙ্গার একটি ডাটাবেইস তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ।
◘ রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও প্রাথমিক চাহিদাপূরণে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহে ও তার ব্যবস্থাপনায় জাতিসংঘের সাথে একযোগে কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
◘ মুসলমান জঙ্গিবাদ ও জঙ্গি সংগঠন বিরোধী কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করা।
◘ রোহিঙ্গা জনগোষ্টির মাঝে মুসলমান জঙ্গিবাদ বিরোধী মতাদর্শ প্রচার করা।
◘ রোহিঙ্গা জনগোষ্টীর মাঝে মুসলমান জঙ্গিবাদ যাতে প্রসার লাভ না করতে পারে, তার জন্য কর্মসূচী হাতে নেয়া।
◘ আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার আদালতে মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে প্রমাণসহ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ।
◘ বিশ্বে জনমত সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা ও কর্মসূচী হাতে নেয়া।
◘ আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় ও সংগঠনগুলোকে প্রভাবিত করা যাতে আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় ও সংগঠনগুলো মায়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চাপ সৃষ্টি করে।
◘ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মায়ানমার যাতে বাধ্য হয়, সেজন্য প্রচলিত বৈধ পন্থায় আর্ন্তজাতিক আইন মেনে সামরিক-বেসামরিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মায়ানমারের করণীয় যা হতে পারে:
◘ ঐতিহাসিকভাবে এটা প্রমাণিত যে, রোহিঙ্গারা আরাকানের স্থায়ী অধিবাসী। তাই, মায়ানমার সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব প্রদান করা।
◘ রোহিঙ্গাদের জন্য কমপক্ষে পঁচিশ বর্ষব্যাপী উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ।
◘ মায়ানমারের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের জন্য যে গ্যাটোগুলো আছে, সেগুলোর অবসান ঘটিয়ে রোহিঙ্গাদের পূর্ণবাসন দেয়া।
◘ বিভিন্ন রাষ্ট্রে (বিশেষত: বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সৌদিআরব) যেসকল রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আছে, তাদের মায়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে পূর্ণবাসন দেয়া।
◘ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঠেকাতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া।
◘ আরাকানের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের জন্য স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের ব্যবস্থা করা।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের করণীয় যা হতে পারে:
◘ আর কোন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না দেয়া।
◘ যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে, তাদের তালিকা তৈরী করা ও কড়া নজরদারীর ব্যবস্থা করা। রোহিঙ্গারা নীতিমালা প্রণয়ন; যার মাধ্যমে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের কি কি সুবিধা বাংলাদেশ সরকার প্রদান করবে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে থাকতে হলে কি কি বিধিমালা মেনে চলতে হবে, তার উল্লেখ থাকবে।
◘ যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে, তাদের পর্যায়ক্রমে আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় ও সংগঠনের সহায়তায় মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা। এছাড়া, রোহিঙ্গা রিফিউজিদের তৃতীয় কোন দেশে প্রেরণের বিষয়ে প্রচেষ্টা চালানো।
◘ আর্ন্তজাতিক ও স্থানীয়ভাবে মায়ানমার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে এবং আরাকানের উত্তরাঞ্চলে স্বায়ত্বশাসন দেয়।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আর্ন্তজাতিক সংগঠন ও সম্প্রদায়ের করণীয় যা হতে পারে:
◘ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রেরণ করা।
◘ মায়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে করে, মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব প্রদান করে।
◘ আরাকানের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের জন্য স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের ব্যবস্থা করা।
◘ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
◘ রোহিঙ্গাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ পূর্নবাসন কর্মসূচী হাতে নেয়া।
রোহিঙ্গাদের উপর যা করা হচ্ছে, তাকে এখন আর দাঙ্গা বলা যাবে না। রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানকল্পে আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় ও সংগঠনগুলোর এবং জড়িত পক্ষগুলোর এখনই ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
মানুষ হিসেবে আমাদের সবারই রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো জরুরি। রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো, রোহিঙ্গাদের উপর হওয়া নিপীড়ণের প্রতিবাদ করা মানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়াকে সমর্থন করা নয়। যারা আশ্রয়ের কথা বলে তারা বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার কথা বলে প্রকারান্তে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গা ইস্যুর কোন সমাধান নয়। আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে রোহিঙ্গাদের উপর মায়ানমারের করা এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করা উচিত।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)