গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার একটি নতুন যুগের জন্য প্রস্তুত মিয়ানমারের ভোটারদের মুখে তৃপ্তির হাসি। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের একটি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চায়। ২৫ বছরের মধ্যে প্রথম বহুদলের অংশগ্রহণের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বিশাল জয় পেয়েছে নোবেল বিজয়ী গণতন্ত্রের নেত্রী অং সান সু চি’র দল ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমেক্রেসি (এনএলডি)’।
মিয়ানমারের ভোটারদের মুখে যদিও তৃপ্তির হাসি, কিন্তু এই হাসির মধ্যেও দেশটির অনেক ট্র্যাজিক বাস্তবতা লুকিয়ে আছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ক্রমাগত বর্জন এবং নিপীড়ন। এই ইস্যুই গত অর্ধ-শতাব্দী ধরে কঠোর সামরিক শাসন এবং আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার দ্বারা জর্জরিত একটি দেশে গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত একত্রীকরণের উপর ছায়ার মতো দেখায়।
রোহিঙ্গা মুসলিমদের বলা হয় ‘বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী।’ তারা মিয়ানমারের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে (পূর্বে আরাকান রাষ্ট্র) তাদের স্বীকৃতির জন্য কয়েক দশক ধরে লড়াই করেছেন। ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা জেনারেল নে উইন মিয়ানমরের (সেসময় বার্মা নামে পরিচিত) ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর নাগরিকত্বের প্রশ্নে অনেক শর্তাবলী জুড়ে দেয়া হয়।
এর আগে মিয়ানমারের জাতির পিতা অং সানের স্বল্পস্থায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাহী কমিটিতে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কিন্তু নে উইনের সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে। তারা বলে, রোহিঙ্গারা অ-বার্মিজ ও অ-বৌদ্ধ এবং বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী, ১৮২৩ সালে ব্রিটিশ শাসনের সময় তারা মিয়ানমারে প্রবেশ করে। কিন্তু বিভিন্ন দলিলে প্রমাণ আছে, এর বহু আগে থেকেই আরাকানে বসবাস ছিলো রোহিঙ্গাদের।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমার যে ‘নিষিদ্ধ’ শব্দ ব্যবহার করে, আন্তর্জাতিক অনুরোধের পরও তার ব্যবহারের অনুমোদন করেনি সরকার।
জাতিকে পরিশুদ্ধ করা, অবৈধ ও অবাঞ্ছিত বিদেশী উপাদান উপড়ে ফেলার নামে ১৯৭৮ সালে ‘অপারেশন নাগা মিন’(বার্মিজ নাম কিং ড্রাগন) শুরু করে সরকার। এই অপারেশনের আওতায় বার্মিজ সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে, মসজিদ ধ্বংস করে, নির্বিচারে গ্রেফতার ও নারীদের ব্যাপকভাবে ধর্ষণ করে। তাদের লক্ষ্য ছিলো রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া। ওই সময় প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
১৯৯১ সালে অং সান সু চি গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় সামরিক সরকার আবার অভিযান চালায়। এসময় ‘অপারেশন পাই থায়া’(পরিছন্ন এবং সুন্দর জাতি) অভিযানে ২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা দেশ ছাড়া হয়। আজও হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিছক বেঁচে থাকার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আড়ম্বরহীন এবং অবাঞ্ছিত উদ্বাস্তুদের মতো পড়ে আছে।
মানব পাচার, দাসত্ব, অনির্দিষ্টকাল ধরে আটক ও বাঁচার জন্য নৌকায় পালিয়ে যাওয়া এসব রোহিঙ্গারা মিডিয়ার কল্যাণে ব্যাপকভাবে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করে। বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো জাতির কাছে পালিয়ে আসা এসব মানুষ ‘নৌকা মানুষ’ পরিচয়ে চরম দুর্দশার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। তবে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার অন্তর্নিহিত কারণ অনেকটাই আড়ালে রয়ে গেছে।
১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের আগে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বদের স্বীকৃতি ছিলো না। যদিও একই সময়ে ১৩৫টি সংখ্যালঘু জাতি স্বীকৃতি পেয়েছিলো। ১৯৮২ সালের আইনের পর রোহিঙ্গারা ভোট দেয়ার অধিকার পেলেও সম্প্রতি আবারও ভোটের অধিকার হারায়। সর্বশেষ রোববারের নির্বাচনেও তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি।
নাগরিকত্বের অস্বীকৃতি ও ভোটাধিকারের সঙ্গে অনেক মৌলিক অধিকারও হারিয়েছে রোহিঙ্গারা। ভ্রমণ, বিয়ে, বাড়ি মেরামত ও সন্তান নেয়ার মতো কাজে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। এসব অনুমতির জন্য তাদের বড় অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়। রোহিঙ্গাদের জন্য সন্তান নেয়ার সীমা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। তারা দুটির বেশি সন্তান নিতে পারেন না। অনেক রোহিঙ্গাকে জোর করে দাসের মতো কাজ করানো হয়। আর রোহিঙ্গা নারীদের জোর করে পতিতালয়ে পাঠাচ্ছে স্থানীয় নিরাপত্তাবাহিনী।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদারীকরণের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ রোহিঙ্গাদের জীবনে সামান্য উন্নতি আলো দেখালে আবার রোহিঙ্গাদের উপর আরো বেশি মাত্রায় নির্যাতন শুরু হয়। বৌদ্ধ দাঙ্গাবাজরা রোহিঙ্গাদের শত শত বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা উপস্থিতির বিরুদ্ধে অব্যাহত নিপীড়ন চলছে। এমনকি এর সমর্থনে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের (ধর্মগুরু) বিক্ষোভ পর্যন্ত করতে দেখা গেছে।
২০১০ সালে গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পেলে অনেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য যে, তিনি এই ব্যাপারে পুরো নিশ্চুপ। সম্প্রতিক হিসংতার জন্য বরং উভয় পক্ষকে সমানভাবে দোষী করেন তিনি।
একজন মানবাধিকার কর্মী থেকে রাজনৈতিক ‘আইকনে’ পরিণত হওয়া সু চি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজদের কাছেই ভোট চেয়েছেন। ভোটযুদ্ধে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাননি। আর এ জন্যেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলা চরম অবিচার নিয়ে কোনো টু-শব্দ করেননি।
সু চি’র সরকারকে সামরিক শাসনের অর্ধ-শতাব্দীর ভুলকে শুধরে নিতে হবে। প্রতিধ্বনিশীল এবং স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য মিয়ানমারের সব মানুষকে সম্মান জানাতে হবে। গণতান্ত্রিক আইনের আওতায় রোহিঙ্গাদের মতো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোকে নাগরিকত্ব ও সমান সুযোগ দিতে হবে।
যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকারের বৈধতা এবং শক্তির পরীক্ষা তার সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর পরিচর্যার মাধ্যমে নিরুপণ হওয়া উচিত। সে মতে মিয়ানমারের নতুন এনএলডি সরকারের জন্য প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হওয়া উচিত রোহিঙ্গাদের সহজ স্বীকৃতি। আর এটা না হলেই বিপদ।
(হাফিংটন পোস্টে হ্যারিসন অ্যাকিন্স’র লেখা)