শিষ্টাচার- এর আরবি প্রতিশব্দ আদব। মানব জীবনের প্রতিটি কাজে শিষ্টাচার অত্যাবশ্যক। একজন মুসলমানকে তার জীবনের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে ইসলাম ধর্মের শিষ্টাচার হলো আল্লাহ যা কিছু আদেশ করেছেন, তা পালন করা এবং যা কিছু নিষেধ করেছেন তা পরিহার করা। রমজানের রোজার সাথে বিশেষ করে সাহরি, ইফতার, কুরআন তিলাওয়াত এসব বিষয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার রয়েছে।
রমজানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি বিষয় সাহরি। সাহরির শিষ্টাচার অত্যন্ত চমৎকার। দোজাহানের বাদশা রাসূলুল্লাহ (সা.) এই সাহরির বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাও কেননা সাহরিতে বরকত রয়েছে।’ [সহীহ বুখারি ও মুসলিম: ১৯২৩ ও ২৬০৩]
এবার আরেকটি বিষয় স্পষ্ট না করলেই নয়, সেটি হলো উত্তম সাহরি কী দিয়ে করবেন? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর একটি হাদিস এখানে প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপন করলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: মুমিনের উত্তম সাহরি হলো খেজুর। [সুনানে আবু দাউদ, ২৩৪৭]
অথচ আমরা শুধু ইফতারিতেই খেজুর খাওয়া উত্তম মনে করি। আসলে আমার নিজেরও এবারের রমজানের আগে এই হাদিসটি জানা ছিল না। আর না জানার কারণেই হয়তো মানা হয় না। তাই তো আল্লাহ পবিত্র কুরআন শুরুই করেছেন ‘ইক্বরা’ বা ‘পড়’ শব্দ দিয়ে। কেননা জানা থাকলে যে কোনো বিধান পালন করা সহজ হয়।
রমজানের রোজা পালনে সাহরি খাওয়ার বিধান সুন্নাত। সাহরি খেলে রোযা পালনে কষ্ট কম হয়। একটি বিষয় এখানে তুলে ধরা আবশ্যক মনে করছি, সেটি হলো সাহরির উত্তম সময় কখন? এ বিষয়ে কুরআন ও হাদিসের স্পষ্ট সমাধান রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, তারা শেষরাতে অর্থাৎ সাহরির সময় ক্ষমা প্রার্থনা করে। [সূরা যারিয়াত, আয়াত:১৮]
এছাড়াও হাদিস থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা.) সবসময় শেষ সময়ে সাহরি খেতেন। এতে যেমন সাহরির আগে তাহাজ্জুদ পড়ার সুযোগ থাকতো তেমনি শেষ সময়ে সাহরি করাতে ফজরের নামাজের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো না। যেকারনে ফজরের নামাজও জামাতে আদায় করা নিশ্চিত হতো। তাই সেহরিতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল (সা.) এর মহা মূল্যবান শিষ্টাচার আমাদের অনুসরণ করা আবশ্যক।
ইফতার
ইফতারের সময়টি আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দের। এসময় যখন কোনো ব্যক্তি ইফতার সামগ্রী নিজের সামনে রেখে নিদিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, তখন আল্লাহ ওই ব্যক্তির তাকওয়া (আল্লাহর প্রতি ভয়) ও আনুগত্য দেখে ব্যাপক খুশি হন। যে কারণে ইফতারের সময় আল্লাহর কাছে আমাদের দোয়া সহজেই কবুল হয়।এ ব্যাপারে নবীজি (সা.) বলেছেন: ইফতারের সময় আল্লাহ বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন আর এটি রমজান মাসের প্রত্যেকটি রাতে এবং রোযা পালনকারী প্রত্যেক ব্যক্তির দোয়া কবুল হয়। [বায়হাকি: ৩৬০৫] অপর হাদিসে বলা হয়েছে, তোমরা যখন ইফতার কর, তখন খেজুর দ্বারা ইফতার কর। কেননা এর মধ্যে বরকত রয়েছে। আর যদি খেজুর না পাও তবে পানি দ্বারা ইফতার কর। কেননা পানি পবিত্র। [সুনানে আবু দাউদ ও সুনানে তিরমিযি: ২৩৫৫ ও ৬৫৮,৬৯৪,৬৯৫]
কুরআন
রমজান মাসে কুরআন নাযিল হওয়ায় এ মাসের মর্যাদা অন্যসব মাসের তুলনায় অনেক বেশি। তাই এ মাসে বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা জরুরি। কেননা হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, রোজা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে; রোজা বলবে, হে প্রতিপালক! আমি দিনের বেলা তাকে পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। আর কুরআন বলবে, হে প্রতিপালক! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল কর। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, সেসময় উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে। [মুসনাদে আহমদ: ৬৬২৬]
এক্ষেত্রে একটি বিষয় বলতেই হয়, সেটি হলো কুরআন শুদ্ধভাবে এবং শব্দ ও আয়াতের অর্থ বুঝে তিলাওয়াত করার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এতে ভুল হলে অর্থের পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন সুপারিশ তো দূরের কথা উল্টোটাই ঘটার সম্ভাবনা বেশি। মন খারাপ করার দরকার নেই; কেননা হাদিসে বলা হয়েছে, আল্লাহ মানুষের আকার-আকৃতি দেখেন না বরং তিনি দেখেন তাদের কলব (অন্তর) এবং আমল (কাজ)। এর মানে আপনি বুঝতেই পারছেন কুরআন শেখার জন্য আপনার চেষ্টাটাই মুখ্য বিষয়।অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যে নিজে কুরআন শিখে ও অন্যকে শেখায়। [ সহীহ বুখারি:৫০২৭] আবার সহীহ কুনুযুস সুন্নাহ ওয়ান নবুবিয়্যাহতে বলা হয়েছে, যে কিতাবুল্লাহ (কুরআন) থেকে একটি আয়াত অন্যকে শেখাবে, এতে যত তিলাওয়াত হবে সে তার সাওয়াব পাবে।
সাধারণ শিষ্টাচার
রমজানের এই সময়টাতে উপর্যুক্ত বিষয়ের সাথে আরও কিছু সাধারণ শিষ্টাচার মেনে চললে হয়তো পরকালে অনেক বড় নাজাতের ফয়সালা হয়ে যেতে পারে। যেমন- পরিবারের সব সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক ও সদাচরণের অভ্যাস গড়ে তোলা, আত্নীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখা, প্রতিবেশীর খোঁজ নেয়া, সুদি লেনদেন, মিথ্যা বলে ধোঁকাবাজি, ঘুষসহ সব ধরনের দুর্নীতি, মাদক সেবন, ব্যভিচারের মত গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকা।
হাদিসে এসেছে, এমন অনেক রোজাদার ব্যক্তি আছে যারা উপোস থাকা ছাড়া আর কিছু পায় না। আবার অনেক রাতজাগা নামাজ আদায়কারী আছে যারা রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না।[সুনানে দারেমী: ২৭২০]
হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ইসলামে বলা আছে, মানুষের ইমান ভয় ও আশার মাঝে নিহিত। অর্থাৎ কেউ যদি প্রচণ্ড রকমের ভালো কাজ করে তখন সে আশা প্রকাশ করে আমি জান্নাতে যাবো আবার মুহুর্তের মধ্যে আল্লাহর কোন বিধান পালনে ব্যর্থ হলে মনে করে আমার থেকে পাপী এই পৃথিবীতে কেউ নেই; জান্নাতে যাওয়া তো দূরের কথা। এটিই বাস্তবধর্মী ইসলামের অপরুপ উপমা।
রমজানে দুনিয়াবি ব্যস্ততা কমিয়ে দিয়ে প্রত্যেকটি কাজে ভারসাম্য বজায় রাখা আবশ্যক। তাই যার যার কর্মক্ষেত্রে অনর্থক কথাবার্তা পরিহার করে এই সময়ে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য সর্বাত্নক চেষ্টা বিদ্যমান রেখে প্রতিটি কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যেতে পারে।আরেকটি বিষয়, সেটি হলো চলমান মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি অনেকটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, তিনি মানুষকে বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করতে চান। মুসলিম হিসেবে এই পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্য এসময় অভুক্ত-অনাহারী, কর্মহীন মানুষের পাশে দাঁড়ানো খুবই কল্যাণকর কাজ। এ কাজের মধ্যে অন্যতম হলো- কাউকে ইফতার করানো, সাহরি খাওয়ানো,যাকাতের হকদারকে যাকাতের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করা, সদকাতুল ফিতরের বিধান মোতাবেক ফিতরা দেয়া। এছাড়াও এই সময়ে ব্যাপকভাবে দান সদকা করে পৃথিবী ও পরকালে নিজের কামিয়াবি (পরিপূর্ণ সফলতা) আরও বেশি নিশ্চিত করা সহজ।
নাতিদীর্ঘ আলোচনার শেষপ্রান্তে এসে বলবো, হাদিসে এসেছে নবী করিম (সা.) ছিলেন মানুষের মাঝে সবথেকে বেশি দানশীল। আর রমজান মাসে তাঁর দানশীলতা আরো বেশি বেড়ে যেত। [সহীহ মুসলিম:৩২০৮] সুতরাং রহমত, বরকাত ও মাগফিরাতের এই মাসে উপর্যুক্ত সব শিষ্টাচার মেনে আমাদের বেশি বেশি দান করে জান্নাতের পথ সুগম করাই হবে বুদ্ধিভিত্তিক কাজ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)