তাকওয়া অর্থ বেঁচে থাকা, দূরে থাকা, ভয় করা। পরিভাষায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সব আদেশ মান্য করা আর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বেঁচে থাকা। রোজা ও তাকওয়া একটি অন্যটির সাথে জড়িত। কারণ রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। সম্ভবত তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। (সূরা বাকারা: ১৮৩) কোরআনের এ আয়াত স্পষ্ট করে দিয়েছে, রোজাদার যদি তার আদায়কৃত রোজার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনে সফল না হয়, তবে রোজার এ কষ্ট-ক্লেশ ব্যর্থ। রাসূল সা. বলেছেন, এমন অনেক রোজাদার আছে, যার রোজা কেবল ক্ষুধার্ত থাকার নামান্তর। আর এমন অনেক রাত জেগে ইবাদতকারী আছে, যাদের ইবাদত কেবল রাত জাগার নামান্তর।’ (মুসনাদে আহমদ: ৯৬৮৩)
খলীফা উমর বিন আব্দুল আজীজ (র.) বলেন, দিনে রোজা রাখা বা রাত জেগে ইবাদত করার নামই কেবল তাকওয়া নয়; বরং তাকওয়া হলো আল্লাহ যা ফরজ করেছেন, তা মানা এবং তিনি যা হারাম করেছেন তা থেকে দূরে থাকা। উমর বিন খাত্তাব (রা.) নবীজীর আরেক সাহাবী উবাই ইবনে কাব (রা.)কে তাকওয়ার পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিলেন, আপনি কি কাঁটাযুক্ত পথে চলেছেন? উমর (রা.) বললেন, হ্যাঁ। উবাই বিন কাব ফের বললেন, কীভাবে চলেছেন? উমর (রা.) বললেন, গায়ে কাঁটা না লাগে সেজন্য চেষ্টা করেছি ও সতর্ক থেকেছি। উবাই (রা.) তখন বললেন, এটাই তাকওয়ার উদাহরণ।
রোজার সাথে তাকওয়ার নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। এটা বান্দার মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি করে। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার মূল উদ্দেশ্য কেবল উপবাস নয়; বরং তাকওয়া অর্জন করা। যে তাকওয়া তাকে আল্লাহর পরিচয় দিবে, তার গুনাবলীর সাথে তাকে পরিচয় করাবে। তাছাড়া বান্দা রোজা কেবল তাকওয়ার ওপর নির্ভর করেই রাখে। অন্য সকল ইবাদতে লোক দেখানোর সুযোগ থাকে। নামাজ, যাকাত, হজ ব্যক্তি আল্লাহকে খুশি করার জন্য যেমন আদায় করে, তেমনি এ সুযোগও থাকে যে, মানুষ দেখুক আমি নামাজি, যাকাতদাতা বা হাজী। কিন্তু রোজার ক্ষেত্রে এ সুযোগ কম। রোজার মাসে বান্দা একাকী অন্ধকার প্রকোষ্ঠবব্ধ ঘরে নিভৃতে কিছু খেয়ে নিতে পারে, কেউই দেখার সুযোগ নেই, কিন্তু বান্দা জানে যে মহান মনীবকে খুশি করার জন্য তার রোজা তিনি কিন্তু সবই দেখছেন। এই যে একটা অনিন্দ্য সুন্দর অনুভূতি এটিই তাকওয়া।
এ জন্য আল্লাহ বলেছেন, ‘রোজা আমার জন্য, আরা আমিই এর প্রতিদান দিব।’ (বুখারী: ৬৯৩৮) অন্য কোনো ইবাদতের প্রতিদান দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেননি, আমি নিজে দেব। কেবল রোজার ব্যাপারে আল্লাহ এ ঘোষণা দিয়েছেন। তাই কোনো রোজাদার কখনো তিরস্কার, ব্যাঙ্গোক্তি, দাম্ভিকতা, গর্ব-অহংকার, অশ্লীল কথাবার্তা, হিংসা-বিদ্বেষ, মিথ্যা, ধোকা দান করতে পারে না।
তাকওয়ার অনেক ক্ষেত্র আছে। তা কেবল রোজা পালনের ক্ষেত্রেই নয়; বরং জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাকওয়ার পরিচয় দিতে হবে। রোজা অবস্থায় আমরা যে আল্লাহর ভয়ে গোপনে, নিভৃতে পানাহার ও স্ত্রীসহবাস থেকে পরহেজ করি, সে আল্লাহকে জীবনের প্রতিটি ক্ষণে স্মরণ করতে হবে। তিনি সর্বদ্রষ্টা, সর্বজ্ঞানী এ বিশ্বাস সদা-সর্বদা রাখতে হবে। আচার-ব্যবহার, চলাফেরা, লেনদেন সর্বক্ষেত্রেই আল্লাহভীতি থাকতে হবে। এমনটি না হলে রোজা কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং সে অনুযায়ী কাজ ছাড়তে পারলো না, আল্লাহর কাছে তার রোজা রেখে পানাহার ত্যাগ করার কোনো মূল্য নেই।’ (বুখারী: ১৭৭০)
তাকওয়ার চেয়ে অধিক মর্যাদাবান কোনো কাজ নেই। এটা মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের মূল ভিত্তি হলো তাকওয়া। আর রমজান মাসেই তাকওয়া অর্জনে ব্রতী হওয়া প্রতিটি মুমিনের একান্ত কর্তব্য। মনে রাখতে হবে আল্লাহর প্রিয় পাত্র হতে হলে তাকওয়ার বিকল্প নেই। তাকওয়া দেখানো কোনো বিষয় নয়: বরং এর জায়গা হচ্ছে মুমিন আত্মা। রাসূল (সা.) তার সীনা মোবারকের দিকে নির্দেশ করে বলেছিলেন, তাকওয়া হলো এখানে। (মুসলিম: ৪৬৫০) কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে ব্যক্তি যে মুত্তাকী তথা তাকওয়াবান। (সূরা হুজুরাত: ১৩)
লেখক: মাওলানা মোহাম্মদ বদরুজ্জামান রিয়াদ