চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

রোকেয়া, বিদ্যাসাগর, বাল্যবিবাহ ও শেখ হাসিনার উক্তি

ভারতবর্ষের সবচেয়ে আলোকিত মানুষটির নাম সম্ভবত বেগম রোকেয়া। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার মতো মেধাবী, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মননশীল, সাহসী নারী বাঙালি সমাজে আজও বিরল। তিনি তার কর্ম ও রচনা দিয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন। শিক্ষা আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবে না-একথা তিনি অনেক জোরের সঙ্গে বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই নারী সমাজ নীরব সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে পারবে। নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে তিনি নারীকে তার স্ব-মহিমায় প্রজ্জ্বলিত হবার শক্তি জুগিয়েছেন।

নারী জাগরণ ও নারী শিক্ষার প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা। বিদ্যাসাগর যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন বাংলার পুরুষশাসিত সমাজে নারীর কোনো মর্যাদাই অবশিষ্ট নেই। না আছে তার শিক্ষাগ্রহণের অধিকার, না আছে তার নিজের শরীরের উপর নিজের অধিকার, না আছে তার পছন্দের কোনো বস্তু কিংবা ব্যক্তির উপর অধিকারটুকুও। পুরুষরা পছন্দ করে না বলেই মেয়েরা বই ধরে না, পাঠশালায় যায় না। মেয়ে মানেই বাবা-মায়ের কাছে মস্ত বোঝা। তাই সেই বোঝা হালকা করার মতো করেই তাদের স্বামী ঘরে বিদেয় করা হয়। কন্যার বয়স কত? ন’বছর কী আরও কম! বিয়ের জন্য ন’বছর কিংবা তার চেয়েও কম বয়সই নাকি আদর্শ! ওই বয়সী কন্যার বিবাহ দেওয়া নাকি ‘গৌরী দান’-এর মতোই পবিত্রকর্ম। আর এমন কাজটি করতে পেরে বাবারা বড়ই গর্বিত হতেন। মায়েদের মন কী বলত কে জানে! নিজের ফেলে-আসা ছোটবেলার কালো ছায়া মিষ্টি মেয়েটির মুখে দেখে কোনো মা খুশি হতে পারেন বলে বিশ্বাস হয় না। তা তিনি এ-কাল, সে-কাল যে কালেরই মা হন না কেন। তবে ব্যাপারটি হলো মায়ের মন কেঁদে আকুল হলেও কিচ্ছুটি বলার জো তার থাকত না। মায়ের মনটি জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যেত যখন তিনি জানতেন, তার আদরের আত্মজার বিয়ের পাত্রটি বয়সে তার চেয়েও বড় কিংবা তার স্বামীই সেই হবু জামাতার অনুজতুল্য! কুলীন ঘরে পাত্রস্থ করার সর্বনেশে অহংকার ধরে রাখতে এইভাবেই কত মেয়েকে সম্প্রদান করা হতো শ্মশানযাত্রীতুল্য বৃদ্ধদেরও হাতে। সেই বৃদ্ধ হয়তো জানেনই না এই কন্যাটি তার কত নম্বর বউ হতে চলেছে!

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজকে এই পাপাচার থেকে মুক্ত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি জোর দিলেন মেয়েদের শিক্ষাদানের উপর। তিনি বললেন, মেয়েরাও পড়বে, পাঠশালায় যাবে। তারপর যাবে উচ্চ বিদ্যালয়ে, কলেজে। এই উদ্দেশ্যে তিনি নিজেই কলম ধরলেন বই লেখার জন্য। তৈরি করলেন মেয়েদের জন্য স্কুল। স্কুল তো হলো, বই তো ছাপা হলো—কিন্তু সেখানে মেয়েরা যে পড়তে আসে না। বাবা-মায়েরা পাঠায় না। সেই বদ্ধ সংস্কার—পড়াশুনো শিখলে নাকি মেয়ে বিধবা হয়ে যাবে! পড়াশুনো শুধু ছেলেদের জন্য, একেবারে পুরুষালি ব্যাপার! অতএব বিদ্যাসাগর মহাশয় বাড়ি বাড়ি ঘুরতে লাগলেন মেয়েদের বাবা-মায়েদের বুঝিয়ে, ভুল ভাঙিয়ে পাঠশালায় মেয়েদের আনার জন্য। তার এই উদ্যোগ ধীরে ধীরে ফলপ্রসূ হলো। আর এটি করতে গিয়ে তিনি আরও উপলব্ধি করলেন, ঘোমটাপ্রথা যেখানে জাঁকিয়ে রাজ করছে সেখানে পড়ানোর কাজে মেয়েদেরও চাই। অতএব স্কুলে শিক্ষিকা নিয়োগ করার পরিকল্পনাও তিনি নিলেন। আশঙ্কামতো বাধার সম্মুখীনও হলেন । তিনি বুঝেছিলেন, যদি মেয়েদেরকে স্কুলের গণ্ডিতে কিছুদিন আটকে রাখা সম্ভব হয় তবে তাদের বিয়ের পিঁড়িতে বসাটাও নিশ্চিতভাবে বিলম্বিত হবে। তারপর মেয়েরা শিক্ষাদীক্ষা পেলে তাদের অধিকারবোধটিও দৃঢ় হবে। যুক্তিবুদ্ধির লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার জন্যও তারা ধীরে ধীরে হয়ে উঠবে পুরুষের সমকক্ষ। শিক্ষা শুধু অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতে এগিয়ে দেবে না, নারীকে করে তুলে স্বাস্থ্যসচেতন, রুচিশীল এবং সংস্কৃতিবান। সমাজের হাল ধরার যজ্ঞেও শামিল হতে পারবে একদিন, নারীও হয়ে উঠবে সর্বার্থেই পুরুষের সমকক্ষ। বেগম রোকেয়াও অনুরূপ ভাবনাই ভেবেছিলেন।

আজও আমরা অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে লক্ষ করি যে, আমাদের দেশে এখনও শতকরা প্রায় ৬৫ শতাংশ মেয়ের আঠারো পেরোনোর আগেই বিয়ে হয়। অর্থাৎ গড়ে এদেশে প্রতি তিনটি বিবাহের মধ্যে দুটি হলো বাল্যবিবাহ। আর এর অনিবার্য পরিণতি মেয়েদের অকালমাতৃত্ব। ফলে, স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ছে মা ও তার সদ্যোজাত শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা।

বাল্যবিবাহ নিরোধের লক্ষ্যে সম্প্রতি আমাদের দেশে একটি আইন মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়েছে এবং সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে।এই আইনে একটি বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে যার মধ্য দিয়ে বাল্যবিবাহকেই আবার যেন আস্কারা দেওয়া হচ্ছে। আইনে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর রাখা হয়েছে বটে, তবে বিশেষ ক্ষেত্রে যেকোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ ‘আদালতের নির্দেশে’ এবং ‘মা-বাবার সম্মতিতে’ বিবাহ হতে পারবে বলে বিধান রাখা হয়েছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।

এ আইনের পক্ষে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘একটি মেয়ে যদি কোনো কারণে ১২/১৩ বা ১৪/১৫ বছর বয়সে গর্ভবতী হয়ে যায়, অথচ গর্ভপাত করানো গেল না। তাহলে যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার অবস্থান কী হবে? তাকে কি সমাজ গ্রহণ করবে? শিশুটির ভবিষ্যৎ​ কী হবে? যদি অ্যাবরশনের বিষয়টি আইনে থাকে, তাহলে সমস্যা নেই। অ্যাবরশন করিয়ে নেবে। আর যদি না থাকে, তাহলে যে মেয়েটি সন্তান জন্ম দিল, তার ভবিষ্যৎ​ কী হবে? এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে এই নতুন আইন। মা-বাবার মত নিয়ে আদালতের মাধ্যমে বিয়ে দিলে শিশুটি সামাজিকভাবে বৈধতা পাবে।’

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত হওয়া কঠিন। সমাজে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’তে সৃষ্ট ‘অবৈধ’ সন্তানকে আইনগত বৈধতা দেওয়া বেশি জরুরি, নাকি এমন ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ বা ‘অবৈধ’ সন্তান যেন জন্ম না হয়-সেটি নিশ্চিত করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ? আইনে এই বিধান রাখলে সমাজে ‘অবৈধ’ সন্তান জন্মদানের যদি হিড়িক পড়ে যায়, তাহলে শিশুবিবাহ ঠেকানো যাবে কীভাবে? এই আইনের কার্যকারিতাই বা কিভাবে হবে?

অভিজ্ঞতা বলে, এই বিশেষ বিধান যদি যুক্ত করা হয়, তাহলে ধর্ষক ও প্রভাবশালীরাই এর সুবিধা নেবে। আমাদের দেশে প্রভাবশালীরা গ্রামেগঞ্জে এখনও অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়েদের জোর করে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। বিশেষ বিধানের সুযোগে তারা একটি মেয়েকে আটকে রেখে তাকে গর্ভধারণে বাধ্য করতে পারে। কদিন চুপচাপ থাকার পর প্রভাবশালীরা আইনের মাধ্যমে এই অপরাধেরও বৈধতা নেবে। একটি অবৈধ ব্যবস্থাকে আইনের মাধ্যমে এভাবে তারা বৈধ করে নেবে। আইনের অপব্যবহারের এমন সুযোগ রাখা হচ্ছে কোন যুক্তিতে?

প্রস্তাবিত এই আইনে মেয়েদের বিয়ের বিষয়ে বাবা-মায়ের মতামতের কথা বলা হয়েছে। ধর্মেও কিন্তু এমনটা নেই। ধর্মেও মেয়েদের মতামতের কথা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ এই বিধানে মেয়েদের মতামতকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। তার মানে এটা হবে এক ধরনের জোরপূর্বক বিবাহ। আইন করেই এ ধরনের জোরপূর্বক বিবাহকে সরকার উৎসাহিত করতে চাইছে। এ ধরনের আইন হবে নারী ও শিশু অধিকারের পরিপন্থী। ‘অপ্রাপ্তবয়সী’ একটি মেয়ে বিবাহ নাও করতে চাইতে পারে। কিন্তু মা-বাবা সম্মতি দিয়েছেন, এই যুক্তিতে ওই মেয়েকে বিবাহ দেওয়া হবে। এতে করে মতপ্রকাশের যে অধিকার, সেই মৌলিক অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হবে না। আর তা সংবিধানসম্মত হবে না।

‘হুকুর হুকুর কাশে বুড়া/হুকুর হুকুর কাশে/নিকার নামে হাসে বুড়া/ফুকুর ফুকুর হাসে।’ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের প্রতি রোকেয়ার কটাক্ষময় ছড়াটি, আমাদের সরস আনন্দ প্রদান করলেও এই হাস্যরসের পেছনে রয়েছে নারীর দুর্বিসহ জীবনের মর্মযাতনা। এই যাতনা অবসানে প্রায় একশ বছর আগে বেগম রোকেয়া চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লড়াই করেছেন।

আজ একশ বছর পর, রোকেয়ার জন্মতিথিতে আবারও নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভবিষ্যৎ-বিনাশী বাল্যবিবাহকে যদি বাস্তবতার দোহাই দিয়ে বিশেষ বিধানের মোড়কে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়, তাহলে আমরা সমাজে মুখ দেখাব কীভাবে? কোন যুক্তিতে বলব, যে আমরা এগিয়েছি?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)