সকালে পত্রিকার পাতা উল্টাতে গিয়ে একটা শিরোনামে চোখ আটকে গেলো। “আজ রুপা হত্যা মামলার রায়”। কিছু সময়ের জন্য মস্তিষ্কও আটকে গেলো। মগজে একটা ভাবনা ঘুরতে থাকলো। কী রায় হবে? অভিযুক্তরা কি শাস্তি পাবে?
টাঙ্গাইলের আদালত সকাল সকাল রায় ঘোষণা করায় অল্প সময়ের মধ্যে সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেলো। মনে এলো স্বস্তি। যদিও জানি, বিচারিক আদালতের রায় পরিবর্তিত হওয়ার সুযোগ আছে। উচ্চ আদালতে আপিল করলে দণ্ডিতদের সাজা কমতে পারে। সে আলোচনা ভিন্ন।
টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রুপাকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় ৪ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন টাঙ্গাইলের আদালত। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলো – ছোঁয়া পরিবহনের চালক হাবিবুর রহমান (৪৫), চালকের সহকারী শামীম (২৬), আকরাম (৩৫) ও জাহাঙ্গীর (১৯)। ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে সহযোগী হলেও বয়স বিবেচনায় বাসের সুপারভাইজার সফর আলীকে (৫৫) সাত বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে।
জরিমানার এক লাখ টাকা এবং রুপা যে বাসে ময়মনসিংহ যাচ্ছিলেন, ছোঁয়া পরিবহনের সেই বাজেয়াপ্ত বাসটির নাম পরিবর্তন করে সেটি রুপার পরিবারকে হস্তান্তর করার আদেশও দিয়েছেন আদালত।
গত বছরের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে কর্মস্থল ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে রুপাকে চলন্ত বাসে পালাক্রমে ধর্ষণ করে পরিবহন শ্রমিকরা। বাসেই তাকে হত্যার পর মধুপুর উপজেলায় পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের মধ্যে রুপার মরদেহ ফেলে রেখে যায়।
পরে এলাকাবাসীর কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ অজ্ঞাত পরিচয় মহিলা হিসেবে তার মরদেহ উদ্ধার করে। পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত নিহত রুপার ছবি দেখে তার ভাই হাফিজুর রহমান মধুপুর থানায় গিয়ে থানায় সংরক্ষিত ছবির ভিত্তিতে তাকে শনাক্ত করেন।
এরপর ২৮ আগস্ট এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ময়মনসিংহ-বগুড়া সড়কে চলাচলরত ছোঁয়া পরিবহনের হেলপার শামীম (২৬), আকরাম (৩৫) ও জাহাঙ্গীর (১৯) এবং চালক হাবিবুর (৪৫) ও সুপারভাইজার সফর আলীকে (৫৫) গ্রেফতার করে মধুপুর থানা পুলিশ।
রুপা ধর্ষনের ঘটনায় সমাজে তোলপাড় শুরু হয়। বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয় সামাজিক মাধ্যম। ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। রাজপথেও নেমে আসেন নারী আন্দোলনকারীরা।
বিচারের দাবিতে জনমত গড়ে তুলতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেন জেলার মির্জাপুরের মির্জা শাহজাহান। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তিনি দৌড়কে বেছে নেন। নিজের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে গত ১৫ বছর ধরে তিনি নিয়মিত দৌড়ান। রুপার ঘটনার পর নিজের পোশাকে ‘রুপার ধর্ষণকারীদের ফাঁসির দাবি চাই’ লিখে দৌড়াতে শুরু করেন মির্জা শাহজাহান। সপ্তাহের প্রতি বুধবার টাঙ্গাইল আদালত ভবনের সামনে থেকে দৌড় শুরু করে শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে আদালত চত্বরে গিয়ে শেষ করেন। প্রথম কিছুদিন তিনি একাই দৌড়ান। পরে স্থানীয় অনেকেই একই দাবি নিয়ে মির্জা শাহজাহানের সঙ্গে যোগ দেন।
টাঙ্গাইল আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে দাবি পূরণ হলো। একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হলো। রুপা যেমন বিচার পেয়েছে তেমনি নাটোরের বড়াইগ্রামের নয় বছরের শিশুটিও যেন বিচার পায়।
প্রকাশিত খবরের জানতে পেরেছি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত কিশোর ওই শিশুটির নিকটাত্মীয়। ভুক্তভোগী শিশু (৯) স্থানীয় একটি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার কিশোরও একই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। মাহবুবুর রহমান (১৬) নামের ওই কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মামলার আরজি সূত্রে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার শিশুটি মাহবুবের মামাতো ভাইয়ের মেয়ে। বিকেলে বাড়িতে কেউ না থাকায় কিশোর মাহবুব মেয়েটিকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেয় মাহবুব। শিশুটি পরে বাড়ি ফিরে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন তার মাকে ঘটনা খুলে বলে শিশুটি। পরে শিশুটির বাবা বড়াইগ্রাম থানায় মাহবুবকে আসামি করে ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মাহবুব ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। অপরাধ স্বীকার করলেও তদন্ত প্রভাবিত করার চেষ্টা চলেছে। প্রথম মেডিকেল রিপোর্ট গায়েব করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। সংবাদ সম্মেলন করে মেডিকেল রিপোর্ট গায়েব করে দেয়ার অভিযোগ করেছেন নির্যাতিতার বাবা। মেডিকেল রিপোর্টে অসঙ্গতি থাকায় উচ্চতর মেডিকেল বোর্ড গঠন করে রিপোর্টটি পর্যালোচনাসহ পুরো বিষয়টি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন শিশুটির পরিবার।
একটি পরিবার কতটা অসহায় হয়ে পড়লে নির্যাতিত শিশুকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন! একই সঙ্গে বিচারের দাবিতে সাহস দেখানো এই পরিবারকে সাধুবাদ দিতে হবে। কারণ ধর্ষণের অনেক ঘটনাই ধামাচাপা দেয়া হয় সমাজ আর লোক-লজ্জার ভয়ে। এই পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ এক বাবা বিচারের দাবিতে মরিয়া।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়েছে, নির্যাতনের পরদিন স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শিশুটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে। মেডিকেল রিপোর্টে তারিখ দেখানো হয়েছে আগের দিন ২৪ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। ঘটনা ঘটেছে ২৫ জানুয়ারি। এছাড়া দেয়া হয়েছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যাথানাশক ঔষধ, বুকের নীচের অংশে কালো দাগ রয়েছে এবং মানসকি অবস্থা খারাপ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য পরীক্ষাকারী চিকিৎসক অভিযুক্তের পরিবারের ঘনিষ্ঠ। তদন্ত প্রভাবিত করতে ওই চিকিৎসক মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েছেন বলে শিশুটির বাবা অভিযোগ করেছেন।
এসএসসি পরীক্ষার জন্য আদালত ৩০ জানুয়ারি থেকে মাহবুবকে ২৪ দিনের জন্য অন্তবর্তীকালীন জামিন দেন আদালত।
অপরাধের ঘটনা অনেক সময় গণমাধ্যমে প্রচারে নিরুৎসাহিত করা হয়। বলা হয়, অপরাধের কৌশল জেনে অন্য অপরাধীরা উৎসাহিত হবে। কিন্তু সারকথা হলো অপরাধের বিচার না হলে অপরাধের সংস্কৃতি তৈরি হয়। অন্য অপরাধপ্রবণ মানুষ অপকর্মে উৎসাহিত হয়। বিচারের দৃষ্টান্ত থাকলে অপরাধ কমে।
এখানে অভিযুক্ত যেহেতু ১৬ বছর বয়সী তাই বিচারটা এমনভাবে করতে হবে যাতে অপরাধপ্রবণ কিশোররাও একটি বার্তা পায়। এটিও মনে রাখতে হবে, ওই কিশোরের পরিবার তাদের ছেলেকে বিচারের মাধ্যমে সংশোধনের পরিবর্তে বিচার এড়ানোর চেষ্টা করছে।
সমাজের দায় থেকেই বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সমাজকে এগিয়ে নিতে নারী-পুরুষ দুটি অঙ্গকেই এগিয়ে নিতে হবে। একটি অঙ্গ পঙ্গু হলে সমাজের পক্ষে, রাষ্ট্রের পক্ষে বেশীদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের মেয়েরা অনেক দূর এগিয়েছে। সামনে আরো অনেক দূর যেতে হবে।
একটি ধর্ষনের ঘটনা একটি মেয়েকে মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেয়। সারাজীবনের ট্রমায় ঢুকে যায় মেয়েটি। তার মানসিক শক্তি ফিরিয়ে আনতে, সমাজের আর দশটি মেয়েকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস যোগাতে বিচার নিশ্চিত করতেই হবে।