বলা হয় ভিন্নমত বা পরমতসহিষ্ণুতা হচ্ছে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আর ভিন্নমত বা বিরোধী মত যদি না-ই থাকে, তাহলে সেটি আর রাজনীতি থাকে না। বরং ভিন্নমতবিহীন রাজনীতি তখন পরিণত হয় তোষামোদিতে। কিন্তু এই ভিন্নমত বা বিরোধী মত দমনে যুগে যুগে ক্ষমতাবানরা প্রতিপক্ষের ওপর যেভাবে দমন-পীড়ন চালিয়েছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।
রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া একজন বিরোধী দলীয় নেতা তথা দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের প্রধানকে হত্যার চেষ্টা অসম্ভব। আবার তৃতীয় কোনো পক্ষ যদি এই ঘটনা ঘটিয়ে থাকে তাহলে ওই সময়ে সরকার তথা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, তার গোয়েন্দা বাহিনী এবং প্রশাসনযন্ত্রের ভূমিকা দিয়েও এটি প্রমাণ করা যায় যে, এ ঘটনায় সরকারের শীর্ষ মহলের সম্পৃক্ততা কতটুকু ছিল। সেই বাস্তবতায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ১৪ বছর আগের এই নারকীয় ঘটনায় আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা যথার্থ এবং এতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে বিএনপিসহ সব দলেরই উচিত এই রায়কে স্বাগত জানানো।
আলোচিত এই মামলার রায়ে আদালতও তার পর্যবেক্ষণে প্রশ্ন তুলেছেন, রাজনীতি মানে কি বিরোধী দলের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ? এই রাজনীতি এ দেশের জনগণ চায় না। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে, তাই বলে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা চালানো হবে? রাজনীতিতে এমন ধারা চালু থাকলে মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়বে।
পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতায় বিরোধী যে দলই থাকবে, বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদারনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। কারণ বিরোধী দলের নেতাদের হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা লোটা মোটেও গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়। রাজনৈতিক জনসমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে রাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ জনগণকে হত্যার এ ধারা চালু থাকলে সাধারণ মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়বে বলেও আদালত মন্তব্য করেন।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, শুরু থেকেই বিএনপি এই মামলার বিচারে পক্ষপাত এবং সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার অভিযোগ এনেছে। পল্টনের পরিবর্তে হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সমাবেশ স্থানান্তর, বিএনপির আমলে চাকরিচ্যুত পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দকে দিয়ে ঘটনার তদন্ত এবং সাক্ষীদের বক্তব্যে সরাসরি তারেক রহমানের নাম আসার পরও মামলায় তাকে জড়ানোকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে বিএনপি অভিযোগ করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যখন এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটলো, তখনকার ক্ষমতাসীন দল, সরকার এবং তাদের আনঅফিশিয়াল সদর দপ্তর হাওয়া ভবনের গোচরের বাইরে কি এই ঘটনা ছিল? সাক্ষীদের বক্তব্যে উঠে এসেছে কীভাবে, কখন, কোথায় বসে এই হামলার পরিকল্পনা হয়েছে। কারা ইন্ধন দিয়েছেন। কারা মৌন সমর্থন দিয়েছেন।
স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময়ও এরকম অনেকে ছিলেন যারা ইতিহাসের বর্বরোচিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা জানতেন। তাদের অনেকে হয়তো সরাসরি নির্দেশ দেননি বা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেননি-কিন্তু তাদের মৌন সমর্থন ছিল। এ কারণে ছিল যে, বঙ্গবন্ধু না থাকলে তাদের পথ পরিস্কার হবে। ওই সময়ের শাসন ব্যবস্থা এবং সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে সরকারে, সেনাবাহিনীতে এবং গোয়েন্দা বাহিনীতে যারা অসন্তুষ্ট ছিলেন-তারা নিরবতা অবলম্বন করেছেন। অথচ তারা সরব হলে নিশ্চয়ই ওই ঘটনা এড়ানো যেতো।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায়ও তৎকালীন সরকার, ক্ষমতাসীন দল, গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকেই হয়তো সরাসরি পরিকল্পনা বা বাস্তবায়নের মাঠ পর্যায়ে যুক্ত ছিলেন না, কিন্তু তারা জানতেন যে কিছু একটা ঘটছে। কিন্তু তারা চুপ ছিলেন। অথচ তারা যদি সরব হতেন, তাহলে এই ঘটনা এড়ানো যেতো। কিন্তু তারা সরব হননি।
দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার আগে যারা নিরব ছিলেন বা মৌন সমর্থন দিয়েছিলেন, তারা হত্যাকারীদের পুনর্বাসিত করেছেন। অর্থাৎ পুরস্কৃত করেছেন। শর্তই ছিল এরকম যে, তোমরা যা করার করো; ধরা পড়লে আমি জানি না। কিন্তু যদি সফল হও, তাহলে তোমাদের সাথে আছি। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে ২১ আগস্টের পরও। এখন ওই ঘটনার মাস্টার মাইন্ড বা মৌন সমর্থনকারী হিসেবে যাদের নাম আসছে, তারাও ঘটনার পরে হামলাকারীদের বাঁচাতে এবং অনেককে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন। শুধু তাই নয়, ঘটনার পর সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হতাহতদের হাসপাতালে নিতে বাধা দিয়েছে বলেও সাক্ষীদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে। সুতরাং এটি খুবই পরিস্কার যে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল এই ঘটনা জানতো। সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে যে ওই ঘটনা ঘটেছে, তার দ্বিতীয় প্রমাণ জজ মিয়া নাটক। সুতরাং এখন বিএনপি যেমন বলছে যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এই রায় দেয়া হয়েছে-সে দাবির সমর্থনে তাদের আসলে জজ মিয়া নাটক, ঘটনার পর হতাহতদের হাসপাতালে নিতে বাধা দেয়া এবং হামলাকারীদের রক্ষা ও পালিয়ে যেতে সহায়তা করার ব্যাখ্যা দিতে হবে।
এই ঘটনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্পৃক্ততা কতটুকু-তাও আদালত বিবেচনায় নিয়েছেন। নিয়েছেন বলেই তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেননি। যদিও আওয়ামী লীগ এবং ওই ঘটনার ভুক্তভোগীরা তার ফাঁসির দাবি জানাচ্ছেন। এমনকি আইনমন্ত্রীও বলেছেন যে, মাস্টার মাইন্ড হিসেবে তারেক রহমানের মৃত্যুদণ্ড না হওয়া দুঃখজনক।
তবে শুধু তারেক রহমান নন; তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা, জাতির জনকের কন্যা এবং দেশের সবচেয়ে পুরনো ও বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধানকে গ্রেনেড মেরে হত্যা করা হবে-এই কথা কি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অজানা ছিল? সে প্রশ্নও উঠছে। যদি তাই হয়, তাহলে বলতে হবে-আমাদের রাজনীতিতে যে প্রতিহিংসা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে-সেটিরই রাষ্ট্রীয় মহড়ার নাম একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা।
এখন এই ঘটনার রায় দিয়ে আমাদের রাজনীতিকরা কি কোনো শিক্ষা গ্রহণ করবেন? তাদের সম্ভবত এই শিক্ষাটা নেয়া উচিত যে, রাজনীতিতে ভিন্নমত বা মতবিরোধ থাকলেই তাকে হত্যা করা যায় না। হত্যা বা হত্যার চেষ্টা হলে একদিন না একদিন তার বিচার হবেই। জাতির জনককে হত্যার বিচার হতে দুই দশকেরও বেশি সময় লেগেছে। কিন্তু বিচার হয়েছে। এই সত্যটি উপলব্ধি করলে তাদের ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত-যাতে ভবিষ্যতে নিজেদের খোঁড়া গর্তে পড়তে না হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)