চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রাষ্ট্র ধর্ম জিন্দাবাদ!

বিতর্কটি অনেক দিন ধরেই চলছিল। শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালত এই বিতর্কের ছেদ টেনেছেন। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চ্যালেঞ্জ করে ২৮ বছর আগে করা রিট আবেদন সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতির অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু ১৯৮৮ সালে এরশাদের শাসনামলে সংবিধানের চরিত্র পাল্টে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হয়।

সংবিধানে ২ (ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে। তখন স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে রাষ্ট্রধর্মের ওই বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন দেশের ১৫ জন বরেণ্য ব্যক্তি। এই ১৫ ব্যক্তির ১০ জন ইতিমধ্যে লোকান্তরিত হয়েছেন। মহামান্য আদালত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগঠনের দাবিটিকেও যেন লোকান্তরে পাঠালেন!

একথা সর্বজনবিদিত যে, ধর্ম নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটা বিষয়। কিন্তু যখন এই বিষয়টি রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে মিলে যায়, তখন দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে খুবই বিপন্ন বোধ করি। কিছু ক্ষোভ, কিছু আর্তনাদ প্রশমন করা যায় না। 

রাষ্ট্রধর্ম কনসেপ্টটি বড় বেশি একদেশদর্শী। একজন স্নেহময়ী মা যেমন কখনই তার নিজ সন্তানদের মধ্যে পক্ষপাত করতে পারেন না, সকল সন্তানই মায়ের কাছে সমান। কোন মা তার একটি সন্তানের নামে বিশেষ সুবিধা, একটি সন্তানের নামে বেশি সুবিধা প্রদান করতে পারেন না। ঠিক তেমনি দেশও নাগরিকদের কাছে মায়ের মত-দেশমাতা। রাষ্ট্রধর্ম বহাল হওয়া মানে দেশমাতা তার সন্তানদের আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় বিভেদের দেয়াল তুলে দিল!

সেখানে আবার হাস্যকরভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মসহ অন্য সকল ধর্মই সমুন্নত রাখার কথা বলা হয়েছে। যেখানে সংবিধানের শুরুতেই একটি বিশেষ ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, সেখানে ‘সকল ধর্মকেই সমুন্নত রাখার’ কথা কিভাবে বলা হচ্ছে? তাহলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করাতেই বা আপত্তি কেন? যেখানে সংবিধানই ধর্মপুষ্ট, সেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থাকতে দোষটা কোথায়? সংবিধান তো ধর্মের পক্ষে!

আমাদের দেশে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নিজেদের জনসমর্থন বৃদ্ধি করতে ধর্মকে ব্যবহার করেছে, এখনও করছে। জিয়াউর রহমান সফল ভাবে সংবিধানের মূল চার নীতির পরিবর্তন করে গেছেন। এরশাদ জিয়ার সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ এনেছেন। তাদের উদ্দেশ্য একটাই ছিল, সহজে সংখ্যায় সর্ববৃহৎ ধর্মভীরু মধ্যবিত্ত সমাজের আস্থা অর্জন! 

এটা সর্বজনবিদিত যে, আলাদা করে রাষ্ট্রের ধর্ম নির্ধারণ করাটা স্রেফ ভণ্ডামি। রাষ্ট্রের মানুষগুলোর হাজারটা ধর্ম থাকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের কেন? ধর্ম থাকবে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের! ধর্ম ব্যক্তির, রাষ্ট্র সকলের। একটি রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রপরিচালনা নীতিতে সেই ব্যক্তিগত বিষয় ধর্মকে কেন বেধে দেবে?

ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো ব্যক্তি পর্যায়েই থাকা উচিত। আর ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোর স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সকল ধর্মালম্বীদের। রাষ্ট্র কখনোই কোন ধর্মের লোকজনদের ধর্ম পালনে কোন নির্দেশনা দিতে পারে না। ধর্ম কখনও রাষ্ট্রের জন্য নয়, এটা মানুষের জন্য। ‘ধর্ম হবে যার যার, রাষ্ট্র সবার’।

আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অনেকে বিকৃত মানে করে ‘ধর্মহীনতা’হিসেবে উপস্থাপন করেন। ধর্মনিরপেক্ষতাকে ‘ধর্মহীনতা’ বলে দেশের বৃহৎ অশিক্ষিত/অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে উস্কানি দেয়া হয়। যদিও ধর্মনিরপেক্ষতা অনেক মহৎ একটি আদর্শ। রাষ্ট্র মানুষের ধর্ম পরিচয় দেখবে না, রাজনৈতিক কারণে ধর্মের অপব্যবহার করা যাবে না এবং ধর্মের কারণে কাউকে বঞ্চিত করা হবে না কোনো নাগরিক অধিকার থেকে। এই বিষয়গুলোকে এক কথায় ধর্মনিরপেক্ষতা বলে, যেখানে রাষ্ট্র ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় না খুঁজে মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে এবং তার নাগরিক অধিকারকে শ্রদ্ধা করবে। প্রকৃতপক্ষে, হিন্দু, ইসলাম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান হল ‘ব্যক্তিগত’ আর ধর্মনিরপেক্ষতা হল ‘সমাজগত’!

আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে রাষ্ট্রধর্ম জুড়ে দেয়া হয়েছে, তখন তা সংখ্যাগুরু ধর্মভীরু মানুষকে খুশি রাখতেই করা হয়েছে। সবই ক্ষমতা বা ভোটের খেলার অংশ। বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের যেসব দেশে যখন বিশেষ কোনো ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, ‘তোমরা বাপু সব সময় পেছনের কাতারে থাকবে, কারণ, এ দেশে তোমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।’

বেশির ভাগ রাজনীতিবিদই কথাটা সরাসরি মানতে চান না। কথার মারপ্যাঁচে তাঁরা বোঝাতে চান, ‘সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক, বাংলাদেশে সবাই সমান।’ এর চেয়ে হাস্যকর কথা হয় কিছু? দেশে ভোট হলে সংখ্যালঘুরা কারো-না-কারো মার খাবেই। জামায়াত-বিএনপি মারবে ভোট দেয়নি বলে, হেরে গেলে কোনো কোনো আওয়ামী লীগ নেতাও সমর্থকদের লেলিয়ে দিতে দেরি করবেন না। দিনের আলোয়, রাতের আঁধারে ভাঙবে, পুড়বে বাড়ি-ঘর-মন্দির। নারীর সম্ভ্রমহানির যাতনা লুকিয়ে সময় বুঝে দেশ ছাড়বে শত পরিবার। ভোট না হলেও রেহাই নেই। সংখ্যালঘুর সম্পত্তি আছে না? তা করায়ত্ত করতেও সুযোগসন্ধানীরা সদা তৎপর। জামায়াত-বিএনপিতো বটেই আওয়ামী লীগও আজকাল এ সুযোগ খুব একটা ছাড়ে না।

‘‘ভোট বা সম্পত্তি না থাকলেই বা কী! যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বা ধর্ম অবমাননার গুজবও সংখ্যাগুরুদের ওপর হামলার অজুহাত হিসেবে যথেষ্ট। একবার-দু’বার নয়, বহুবার দেখা গেছে। তবুও নাকি সবাই সমান। এক সময় সংখ্যায় প্রায় কাছাকাছি ছিল, এখন কমতে কমতে ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে কোনোরকমে টিকে আছে ১০ ভাগ সংখ্যালঘু। তারপরও কোনো কোনো রাজনীতিবিদ, কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীকে বলতে শোনা যায়, ‘ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হতে পারে, তবে বাংলাদেশে আসলে সবাই সমান।’ এর চেয়ে বেদনাদায়ক প্রহসন আর কি হতে পারে!

রাষ্ট্রধর্ম’ মনোজগতে ওই ভূমিটাকেই উঁচু-নীচু করে দেয়। একজনের জন্য যেন সাজানো থাকে পোডিয়ামের উচ্চতম স্থান, বাকিদের দাঁড়াতে হয় নীচে। এভাবে ওপরে-নীচে দাঁড় করিয়ে কেউ যদি বলে, ‘সবাই সমান’, তাহলে কেমন লাগবে? পুরো ব্যাপারটাকেই ভণ্ডামি মনে হবে না?

সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ রেখে সবার সমান অধিকারের কথা বলা সেরকমই ব্যাপার। যেন দারোগা সাহেব সিপাহীকে ডেকে বলছেন, ‘ওহে দেখো তো, ওখানে কী হয়েছে? তিন-চারটে ছেলেকে দেখতে পাচ্ছো তো? মাঝের ওই ছেলেটি কিন্তু আমার সন্তান।’ সিপাহী তারপর কোন ছেলের সঙ্গে কী আচরণ করতে পারে তা একটা আহাম্মকও বোঝে।’’

রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্রের ‘ধর্মকরণ’ করেছিলেন অনেক আগেই। কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এর প্রতিকার চেয়েছিলেন। আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। আদালতের দরজার দিকে তাকিয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ আশাবাদীও হয়ে উঠেছিলেন। ২৮ বছর পর অবশেষে রিট খারিজ করার মধ্য দিয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর শেষ আশার প্রদীপটুকুও নিভে গেল। একটি বিশেষ ধর্মের টুপি পড়ে দেশমাতা এখন সবাইকে স্নেহ দেবে! ধর্ম নিয়ে রইবে না আর কোন সন্দেহ-সংশয়-দ্বিধা! ক্রমে আমরা এখন একই ধর্মীয় রাষ্ট্রের ছাতার তলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানরা লীন হয়ে যাব। এক দেহ, এক প্রাণ, এক রাষ্ট্র, এক ধর্ম, এক জাতি! ঘুচে যাবে সংখ্যালঘু হওয়ার, সংখ্যালঘু হিসেবে নির্যাতিত হওয়ার কষ্ট! 

অতএব রাষ্ট্রধর্ম-জিন্দাবাদ!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)