কিশোরী রিশার ইউনিফর্ম পরা ছবিতে যেনো রাজ্যের মায়া জড়িয়ে রয়েছে। ছবিটি দেখলেই নিজের মেয়ে বা ছোটবোনের কথা মনে পড়ে। প্রতিদিন যে লক্ষ লক্ষ হাজার হাজার কিশোরী আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মুখরিত করে রাখে সুরাইয়া আক্তার রিশা ছিল তাদেরই একজন। রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়তো সে। অন্য দশজনের মতো এই কিশোরীরও স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে সে অনেক বড় হবে। কিন্তু এই সুন্দর পৃথিবীতে রিশার বেঁচে থাকাটাই শেষ করে দিল একজন ঘাতক, দৃর্বৃত্ত।
রিশার নিষ্ঠুর ঘাতকের নাম ওবায়দুল্লাহ খান। গত ২৪ আগস্ট এই ঘাতক প্রকাশ্য দিবালোকে স্কুল থেকে ফেরার সময় রিশাকে চরম নিষ্ঠুরতায় ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। ঐদিন স্কুলের পরীক্ষা শেষে বাসায় যাবার উদ্দেশ্যে ওভারব্রীজ দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল রিশা। হঠাৎ করেই এই ঘাতক আচমকা তাকে ছুরিকাঘাত করে। কোনো কিছু বুঝার আগেই সে পালিয়ে যায়। রিশাকে পথচারী, স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকেরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। আইসিইউতে নেওয়া হয় তাকে। তার আগেই অনেক রক্তক্ষরণ হয়ে গেছে। চিকিৎসকরা তাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলেও ২৮ আগস্ট রবিবার সকালে রিশা সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান। অনলাইন মিডিয়া আর ফেসবুকের মাধ্যমে রিশার অকাল মৃত্যুর সংবাদ জানতে পারে দেশবাসী।
রিশার ঘাতক ওবায়দুল্লাহ একটি টেইলারিং-এর দোকানে কাটিং মাস্টার হিসেবে কাজ করতো। বৈশাখী নামের ঐ টেইলারিং-এ স্কুল ড্রেস বানাতে গিয়েছিল রিশা। ক্যাশমেমো থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে সেই থেকে এই ইতরটি রিশার পেছনে লাগে। রিশাকে নানাভাবে উত্যক্ত করতে থাকে। সর্বশেষ সে কিশোরী রিশার পেটে ছুরি চালানোর হিংস্রতা দেখায়। বুঝা যায়, আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ, বিচার কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। আর মূল্যবোধহীনতা ব্যক্তিকে কতোটা হিংস্র করে তুলেছে।
রিশার এই মৃত্যুর জবাব কী? কোনো জবাব নেই বলেইতো প্রতীয়মান। আর জবাব নেই বলেই রিশার মা তানিয়া এবং বাবা রমজান আলী কাঁদতে কাঁদতে পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছেন। কোনোভাবেই এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছেন না তারা। আর তাই তাদের বিলাপ থামছে না। রিশার মা এখন পাগল প্রায়। প্রিয় মেয়ের জন্যে তিনি কেবলই কাঁদছেন, যাকে দেখছেন তাকে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে ফিরিয়ে পাওয়ার আবদার করছেন। শুধু রিশার মা আর বাবা বলে নয়, টেলিভিশন পর্দায় যারা রিশার মৃত্যু সংবাদটি দেখেছেন তারাও চোখের জল না ফেলে পারেননি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রিশার অকাল মৃত্যুসংবাদ দেখে সবাই চরম ক্ষুব্ধতা না প্রকাশ করে পারেননি। আবার রিশা হত্যার ঘটনায় অভিভাবকদের মাঝে এক ধরনের ভয়, আতঙ্কও তৈরি হয়েছে।
রিশার ঘটনায় আবারো প্রমাণ হলো-আমাদের সমাজের ভেতরটা ভীষণ রকম নষ্ট হয়ে গেছে। আর তাই ফলাফল হিসেবে আমাদেরকে এরকম কুৎসিত কদাকার সব চিত্র দেখতে হচ্ছে। এর আগেও আরও অনেক কিশোরীকে এভাবে জীবন দিতে হয়েছে। বখাটেদের কারণে অনেক কিশোরীকে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। ইভটিজিং-এর নির্মম শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া খুলনার ফারজানা আক্তার রুমি, রাজধানীর নান্দীপাড়া ইস্ট পয়েন্ট স্কুলের ছাত্রী কুলসুম, বনশ্রী মডেল স্কুলের ইলোরা, পাবনা ভাঙ্গুরা উপজেলার কাজলী, ঈশ্বরদী উপজেলার বৃষ্টি ও ফাহিমা, গাইবান্ধার সাদুল্লাহপুর উপজেলার মাদ্রাসা ছাত্রী নুরানী, বগুড়ার কেশবপুরের রেশামসহ আরও অজস্র বোনকে আমরা ভুলে যায় নি। যারা ইভটিজিং- এর যাতনা, নির্মমতা সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
আমরা জানি রিশার ঘটনা নিয়ে রাজনীতিবিদরা খুব একটা নড়াচড়া করবেন না। কথাও বলবেন না। কারণ এর সাথে রাজনীতির সম্পর্ক নেই। রাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত নেই। রিশার পরিবারের রাষ্ট্রের কাছ থেকে যতটুকু সহানুভূতি পাওয়ার কথা সেটা পাবেন বলে মনে হয় না। আর তাই মেয়ে হারানোর কষ্ট তাদেরকে একাই ভোগ করতে হবে। একা একা কাঁদতে হবে। ন্যায়বিচার পাবেন কিনা সেখানেও রয়েছে শত সহস্র প্রশ্ন। খুনী ধরা পরবে কিনা তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। অথচ উন্নত রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তি এরকম ক্ষতিগ্রস্ত হলে রাষ্ট্র সেখানে দুঃখ ভাগ করে নেয়। আর আমাদের এখানে উল্টোটাই দৃশ্যমান। রাজনীতির জটিল সমীকরণ আর মারপ্যাঁচে পড়ে রাষ্ট্র নিজেই এখানে এক ধরনের আতংক তৈরি করে।
রিশা হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছেন বাবা রমজান হোসেন। মেয়ের স্মৃতি তিনি ভুলতে পারছেন না। সংসারে মেয়ে ছিল তার সহস্র সুখের উৎস। কিন্তু সেই সংসার এখন নিরব-নিথর বিষাদময়। রিশার মা তানিয়া হোসেনকে কেউ সান্তনা দিতে পারছেন না। কাঁদছেন আর কাঁদছেন। কাঁদারই কথা। বুকের ধনকে কেড়ে নিয়ে গেছে শহুরে উদ্ভট এক অজ্ঞাত খুনী। যা তিনি কোনোদিন ভাবেন নি যে নিয়তি এতোটা নিষ্ঠুর হবে। প্রথম আলো আজ লিখেছে রিশার মা তানিয়া হোসেন বলেই যাচ্ছেন ‘আমার বাচ্চা আমারে বইলা গেছে টেইলারের কর্মচারী ওর শরীরের ব্যথা দিছে।’ মেয়ের পেটে ছুরির আঘাত কল্পনায় আনলে কার না মনটা কেঁদে উঠে? মা তানিয়া মেয়ের সেই কষ্টের কথা মনে করতেই ছটফট করছেন এবং কাঁদছেন আর কাঁদছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- রিশার শরীরে যে ব্যথা অনুভূত হয়েছে আমাদের রাষ্ট্র কী সেই ব্যথা অনুভব করে? নইলে রিশারা এভাবে চলে যাবে কেন?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)