সমকালীন বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যা জঙ্গিবাদ। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, উগ্র সাম্প্রদায়িকতার আক্রমণ থেকে পৃথিবীর কোনো স্থানই নিরাপদ নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও নৃশংস জঙ্গি হামলা সংঘটিত হয়েছে। তবে জঙ্গিবাদ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতা দমনে বাংলাদেশের সাহসী পদক্ষেপ পৃথিবীর সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্থিমজ্জায় গ্রথিত ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র ঐতিহ্য জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে তা বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
উগ্র সাম্প্রদায়িকতা বাঙালি জাতির হাজার বছরের লালিত সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে বারবার দংশন করেছে। বিভিন্ন সময় ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিয়েছে শাসকগোষ্ঠী। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১-এ পাকিস্তানি শাসক ও তাদের এদেশীয় দোসর উগ্র মৌলবাদীগোষ্ঠীকে পরাজিত করে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অসাম্প্রদায়িক জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হয়। জন্মলগ্নেই বাংলাদেশকে গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল বাংলাদেশের জন্ম হলেও পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। পরাজিত শক্তি বাংলাদেশকে কখনও মেনে নিতে পারেনি।
১৯৭১-এর ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক থেকে দেশে ফেরার পথে লন্ডন বিমানবন্দরে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বলেছিলেন- পাকিস্তানকে এক করতে তিনি চেষ্টা করে যাবেন।’৭১-এর পরও বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সহায়তায় তাদের সহযোগী জামাত ও তার সদস্যদের নিয়ে সৃষ্ট ‘আল-বদর’, ‘আল-শামস’, ‘রাজাকার’ প্রভৃতি বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার প্রতিশোধ গ্রহণে তৎপর থাকে। তারা যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের নেতৃত্বে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার’ আন্দোলনের নামে বাংলাদেশ-বিরোধী তৎপরতা চালায়। দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ফাঁদে পা দিয়ে মওলানা ভাসানী ও অলি আহাদ প্রমুখ ‘মুসলিম বাংলার’ আওয়াজ তুলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। (সূত্র : বাঙালি সমাজ ও সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ, নূহ-উল-আলম লেনিন)
এ সময় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের সন্ত্রাসী আগ্রাসনে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জাসদের গণবাহিনী, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টিসহ চরমপন্থি সংগঠনগুলো সন্ত্রাসী তৎপরতা, হত্যা, গুপ্তহত্যা, থানা-ফাঁড়ি লুট ও সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ শুরু করে। শ্রেণিশত্রু খতমের নামে শত শত মানুষ হত্যা করে। এমনকি ঈদের জামাতে হামলা করে একজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়। এসব চরমপন্থি সংগঠনের ‘শ্রেণিশত্রু খতম’ মতবাদ আর ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদ মুদ্রার এপিট-ওপিট।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-বিরোধী শক্তি তাদের ষড়যন্ত্রকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নরঘাতকরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধকালীন জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে।১৫ আগস্টের পর পাকিস্তানি ভাবাদর্শের খুনিচক্র রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে বাংলাদেশে আবার উল্টোরথের যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ বেতার হয়ে যায় ‘রেডিও বাংলাদেশ’- ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে ‘জিন্দাবাদ’। এ সময় রাষ্ট্রের মূলনীতিতে আঘাত হানে খুনিচক্র। এমনকি ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ জারি করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। পরে জেনারেল জিয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করেন এবং খুনিদের বিদেশে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন।
১৯৭৫-এর ৩১ ডিসেম্বর ’৭২-এর দালাল আইন বাতিল ঘোষণা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের অভিযোগে গ্রেফতার এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্তদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আস্ফালন এতটাই চরমে পৌঁছেছিল যে, ১৯৭৬ সালের ৫-৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সিরাতুন্নবী সম্মেলনের নামে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামাতকে মাঠে নামানো হয়। সেই সম্মলনে প্রধান অতিথি করা হয় বিমানবাহিনী প্রধান পদে নিযুক্ত পাকিস্তানপন্থি এমজি তওয়াবকে। যে সমাবেশে স্লোগান উঠেছিল- ‘তাওয়াব ভাই তওয়াব ভাই, চাঁদ তারা মার্কা পতাকা চাই।’
১৯৭৬-এর ৩ মে এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল সংবিধানের নবম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনে পরিণত করে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন জেনারেল জিয়া। জিয়া সংবিধানে ধর্মীয় স্লোগান জুড়ে দিলেও মদ, জুয়া, ব্যভিচারসহ বিভিন্ন সামাজিক অনাচারের লাইসেন্স প্রদান করে ধর্মকে ব্যবহার করেন রাজনৈতিক ভাঁওতাবাজির হাতিয়ার হিসেবে। জিয়ার সহায়তায় জামাতের ঘাতক-দালালরা আবার বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করে।
এমন কী জিয়া সরকারের অনুমতিক্রমে ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে এসে এ দেশের রাজনীতিতে ঘাঁটি গেঁড়ে বসে ঘাতক-শিরোমণি গোলাম আজম।১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পিডিপি, মুক্তিযুদ্ধের পর ‘মুসলিম বাংলার’ আওয়াজ তোলা ভাসানীপন্থি ও মাওপন্থি কমিউনিস্ট, পাকিস্তান-ফেরত সামরিক অফিসার-সিপাহী ও সিভিল আমলা, সুযোগ-সন্ধানী, আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী, হিন্দু ও ভারত বিদ্বেষী উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি, পাকিস্তান-প্রেমী ও চীন-প্রেমী পুঁজিপতি লুটেরা ব্যবসায়ীরা একত্রিত হয় জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে জন্ম নেওয়া বিএনপিতে।
মূলত, জন্মসূত্রেই পাকিস্তান-প্রেম এবং উগ্র সাম্প্রদায়িকতা বিএনপির অস্তিত্বের সাথে গ্রোথিত। আর সেখান থেকে উৎসারিত হয়েছে আজকের জঙ্গিবাদী তৎপরতা। জিয়া পাকিস্তানের দালাল ঘাতক শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানান। খন্দকার আবদুল হামিদ, আবদুল আলীমসহ বেশ কয়েকজন ঘাতককে মন্ত্রিসভার সদস্য করেন। যাদের স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে জেলে পাঠানো হয়েছিল। জেনারেল জিয়া জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনেরও চেষ্টা করেন। ধুঁয়া তোলা হয় জাতীয় সংগীত হিন্দুর রচিত গান। বিশিষ্ট সাংবাদিক আজিজুল ইসলাম ভূইয়া তার ‘বিএনপি ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ গ্রন্থে লিখেছেন- চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠান শেষে সার্কিট হাউসে জিয়াকে তার দলের একজন নেতা বলেছিলেন- ‘স্যার, আমাদের পতাকায় ইসলামি রং নেই, এটা আমাদের ভালো লাগে না। এটা ইসলামি তাহজ্জীব ও তমুদ্দুনের সাথে মিলছে না। তার কথার প্রত্যুত্তরে জিয়াউর রহমান বলেন, হবে, হবে সব কিছুই হবে। আগে হিন্দুর লেখা জাতীয় সংগীতটি বদলানো হোক। তারপর জাতীয় পতাকার কথা ভাববো।’
জেনারেল জিয়া শাসনামলের পাকিস্তানিকরণ এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার বিবরণ স্বল্প পরিসরে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। জিয়া উগ্র সাম্প্রদায়িকতার যে বীষবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন পরবর্তীতে এরশাদ-খালেদা পরম যত্নে তা পরিচর্যা করেছেন। মূলত, বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের প্রত্যক্ষ তৎপরতা শুরু হয় ১৯৮৬ সালে ‘ফ্রিডম পার্টি’ এবং মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর হাত ধরে। মুসলিম মিল্লাত বাহিনী মতিউর রহমান নামের চাকরিচ্যুত এক সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রশিদ-ফারুক লিবিয়ায় আশ্রয় নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী জঙ্গিবাদী সংগঠন ‘মুসলিম ব্রাদারহুডের’ সহযোগিতায় ‘ফ্রিডম পার্টি’ নামে একটি ফ্যাসিবাদী সংগঠন গড়ে তোলে। এ সময় পাকিস্তানের আইএসআই ও লিবিয়া সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা পায় ফ্রিডম পার্টি। অধিকন্তু জনশক্তি রপ্তানির নামে তরুণদের লিবিয়ায় নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া হয়। এই তরুণরা দেশে ফিরে ফ্রিডম পার্টির পক্ষে জঙ্গি তৎপরতায় অংশ নেবে- এটাই ছিল ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্য।
এরশাদ ও বেগম খালেদা এই ‘ফ্রিডম পার্টি’কে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। এমন কী বেগম জিয়া ১৯৯৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ‘ফ্রিডম পার্টি’কে সংসদের প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা প্রদান করেন।এরপর ১৯৮৯ সালে এরশাদ আমলে জন্ম নেয় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি-বি) নামের আরেকটি জঙ্গি সংগঠন। এই সংগঠনটি বিএনপি শাসনামলে ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে। বেগম খালেদার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম আমলে সংগঠনটির উত্থান ও বিস্তার ঘটে।এই সংগঠনটি যশোরের উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, খুলনায় আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের কাছে ও হেলিপ্যাডে বোমা পেতে রাখা, রমনার বটমূলে হামলা, গোপালগঞ্জের বানিয়ারচরে গির্জায় হামলা ও নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলাসহ একাধিক জঙ্গি হামলা চালায়।
বিএনপি-জামাত জোট আমলে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াকে হত্যা করে। এমন কী ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গিরা। এ ঘটনায় নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ নেতা-কর্মী নিহত হন। গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি মুফতি হান্নানসহ একাধিক জঙ্গি নেতা জবানবন্দিতে বলেছেন- বেগম জিয়ার পুত্র ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরসহ বিএনপি-জামাতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে সাথে বৈঠক করে ২১ আগস্টের হামলার পরিকল্পনা করা হয়। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তি মতে, এই হামলার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন তারেক রহমান ও জামাত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং এই হামলার গ্রেনেড এসেছিল পাকিস্তান থেকে।
হুজি-বি’র পর বাংলাদেশে সালাফি মতাদর্শী উগ্রপন্থি জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৯৮ সালে জেএমবির সাংগঠনিক যাত্রা শুরু হয়। তবে এ সময় তেমন কোনো কার্যক্রম চালাতে পারেনি জেএমবি। ২০০২ সালে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় এলে পাকিস্তানে যান জেএমবি নেতা শায়খ রহমান। দেশে ফিরে পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বার সহায়তায় জেএমবিকে সংগঠিত করেন তিনি। জেএমবি ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দেশে ২৬টি হামলা চালায়। এ সময় হুজিও বেশ কয়েকটি নাশকতামূলক হামলা চালায়। জঙ্গি নেতা শায়েখ আবদুর রহমান এবং সিদ্দিকুর রহমান বাংলাভাইয়ের উত্থান ঘটে। রাজশাহীর বাঘমারা, নওগাঁর রানীনগর-আত্রাই এলাকায় নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে জেএমবি। আত্রাইয়ে মানুষ মেরে গাছে পা ঝুলিয়ে রাখে। তখন বিএনপি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাভাই হচ্ছে মিডিয়ার সৃষ্টি।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় ৫০০টি স্থানে একযোগে বোমা হামলা, ময়মনসিংহে ফাইলা পাগলার মাজার ও ময়মনসিংহের ৩টি সিনেমা হলে বোমা হামলা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা, দিনাজপুর, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন স্থানে ১৭ আগস্টের পর অসংখ্য আত্মঘাতী হামলায় বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ ৩৩ জন নিহত হন, আহত হন ৪ শতাধিক। ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা করে জঙ্গিরা।বিএনপি-জামাত জোট আমলে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটে। জেএমবি, হরকাতুল জিহাদসহ প্রায় শতাধিক জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ঘটে। সে সময় ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামাতের সহায়তায় পুরিপুষ্ঠ হয়ে ওঠে এসব জঙ্গি সংগঠন।
বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপিদের মদতপুষ্ট ছিল জেএমবি। ২০০৭ সালের ২১ জুন ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়- Tarique Rahman and several ex-BNP ministers directly patronised the outrageous operations of the JMB (Jama’atul Mujahideen Bangladesh) in Rajshahi with the full knowledge of former prime minister Khaleda Zia.Then at the helm of home ministry, Lutfozzaman Babar also joined the bandwagon of JMB leader Bangla Bhai, pouring cold water on feeble attempts by a part of the civil and police administration to resist the terrorist activities.
২০০৭ সালের ৩০ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়- বাংলাভাই রাজশাহীর বিএনপি নেতাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। আর বিএনপি নেতারা আর্থিক, প্রশাসনিকসহ সব ধরনের সহযোগিতা তাকে দিয়েছেন। জেএমবির ধ্বংসাত্মক ও দেশবিরোধী কার্যকলাপে মদদ দিয়েছিলেন বিএনপির অন্তত আটজন মন্ত্রী-সাংসদ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপির নেতা ও উপমন্ত্রী দুলুর সাথে গভীর সম্পর্ক ছিল জেএমবির জঙ্গিদের। ২০০৪ সালের এপ্রিলে শায়খ রহমান ও বাংলাভাই দলবল নিয়ে নাটোরে দুলুর বাসভবনে বেঠক করেন। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অভিযান চালাতে বাংলাভাই মিজানুর রহমান মিনুর কাছে আর্থিক সহায়তা চান। মিনু জেএমবিকে অর্থ সহায়তা প্রদান করেন। পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাভাইয়ের জঙ্গি তৎপরতার সময় তিনি রাজশাহীর ডিআইজি থাকাবস্থায় রাজনৈতিক চাপে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেন নি।
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে শাহবাগে জড়ো হওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ জনতাকে বেগম জিয়া নাস্তিক আখ্যা দিয়েছিলেন। হেফাজতকে মাঠে নামিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের তাদের সাথে যোগ দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি অতীতে যেমন অপপ্রচার করতেন- ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশ ভারত হয়ে যাবে’, ‘মসজিদে মসজিদে উলুধ্বনি হবে’, ঠিক সেই ধরনের নানা অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছিলেন। প্রকাশ্য জনসভায় চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী ও সাকা চৌধুরীদের মুক্তির দাবি তুলেছিলেন।
একইভাবে গুলশানে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর খালেদা জিয়া প্রথমে বিবৃতিতে এই হত্যাকাণ্ডকে ‘রক্তাক্ত অভ্যুত্থান’ বললেন। পরে আবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানালেন। আর কল্যাণপুরের অভিযানের পর হান্নান শাহসহ বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব বক্তব্য-বিবৃতিতে যা বললেন, তা আরও ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত বহন করে। কার্যত, কল্যাণপুরের অভিযানকে সাজানো দাবি করা অর্থ জঙ্গিদের পক্ষাবলম্বন করা এবং পরোক্ষভাবে জঙ্গিদের সাহস জোগানোর অপচেষ্টা।
অনেকেই মনে করেন, বিএনপির সাথে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সংযোগ আর বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থান একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও তার গর্ভে জন্ম নেওয়া জঙ্গি তৎপরতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বারবার সামনে চলে আসে পাকিস্তান, জামাত, শিবির ও বিএনপির নাম। স্বাধীন বাংলাদেশে জেনারেল জিয়া ও বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য খুনিরা উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে বীষবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন আর জামাতের পরিচর্যায় খালেদা-তারেক জঙ্গিবাদের মতো ভয়াবহ দানবকে আশ্রয় দিয়ে- অক্সিজেন দিয়ে শক্তিশালী করে তুলেছেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)