১৯৭১ সালে পাকবাহিনী ও যার দোসরদের উপর যে যত বেশি নৃশংস আচরণ ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে সে তত বেশি দেশপ্রেমিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। উল্টো মুক্তিযোদ্ধাদের উপর যে পাকসেনা কিংবা রাজাকার যত বেশি নৃশংস ভূমিকায় নেমেছে সে তত বেশি ঘাতক, কসাই, দেশদ্রোহী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
যে কোনো যুদ্ধে নৃশংসতার প্রতিযোগিতা প্রথাসিদ্ধ যুদ্ধরীতি। যে মুক্তিযোদ্ধা যে দা দিয়ে কুপিয়ে রাজাকার মেরেছে সেই দা জাদুঘরের সম্মানিত অস্ত্র।যুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনী ও রাজাকার আলবদর মারার জন্য যে সব দেশ অস্ত্র দিয়েছে তারা আমাদের মিত্র আর মুক্তিবাহিনী ও বাঙালি মারার জন্য যারা অস্ত্র দিয়েছে তারা শত্রু। পাকবাহিনীর চোখে তাদের শত্রু বাঙালিরা আর বাঙালির চোখে পাকবাহিনী।
১৯৭১ সালে ছিলো সশস্ত্র যুদ্ধ আর এখন চলছে রাজনৈতিক যুদ্ধ। যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকার আলবদর মুক্ত দেশ গড়ার আইনসিদ্ধ লড়াই চলছে দেশে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনি প্রক্রিয়ায় রাজাকারদের ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে। দেশজুড়ে রাজাকারদের তালিকা সম্বলিত চিঠি দেয়া হচ্ছে প্রতিটি উপজেলায়। এই রাজনৈতিক যুদ্ধ রাজাকার মুক্ত দেশ গড়ার ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষশক্তির শক্তিভিত প্রতিষ্ঠার।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের যেমন সম্মানিত করা হচ্ছে ও তাদের বিশেষ কোটা দিয়ে নানা সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে, ঠিক তেমনই রাজাকারের সন্তানদের তার উল্টোটা করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর নৃশংস ভূমিকায় নামতে হবে। যারা এদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব মানেনি তাদের এ দেশীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা উচিত নয়।
অতীতে রাজাকারদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে যারা তাদের পরিণতি দেশ ও বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে। তেলে জলে যেমন মিশ খায় না তেমনই বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজাকার মিশ খায় না। মিশ খায় না রাজাকারের পুত্রকন্যারাও। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বিশেষ সম্মান প্রদান করলে রাজাকারের সন্তানদের বিশেষ অসম্মান করতে হবে এমনটিই রীতি হওয়া কাম্য।
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে কোনো রাজাকারের পুত্রকন্যা থাকতে পারে না। তেমনই রাজাকারের পুত্রকন্যারা কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না – এমন আইন করা দরকার। এ ব্যাপারে সরকার, সুশীল সমাজ ও স্বাধীনতার স্বপক্ষীয় সকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে সোচ্চার হতে হবে। আগাছা, পরগাছা ও বিষগাছা সমূলে উৎপাটনের এখনই সময়।
১৯৭১ সালের সশস্ত্র যুদ্ধ যেমন দ্বিতীয়বার পরিচালনা করা সম্ভব নয়, বর্তমানে চলমান রাজনৈতিক যুদ্ধও একবার সমাপ্ত করে পুনর্বার শুরু করা সম্ভব নয়। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিকে আপদ, বিপদমুক্ত এখনই করতে হবে। রাজাকারের পুত্রকন্যারা কে কোথায় আছে তা পরিষ্কার করতে হবে। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনগুলোর মাধ্যমে তা খুব সহজেই জ্ঞাত হওয়া সম্ভব।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনো রাজনৈতিক দলে কোনো প্রকার নেতৃত্বেই রাজাকারের পুত্র কন্যারা থাকতে পারে না। এ ব্যাপারে ন্যূনতম কাউকে ছাড় দেয়া সঙ্গত হবে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রভৃতিতে রাজাকারের পুত্রকন্যাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হোক। প্রকাশ্য শত্রুতায় পরাভূত হয়ে মিত্রবেশী ভয়াবহ শত্রুতায় লিপ্ত হতে পারে তারা।
বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের সতর্কভাবে খুঁজে দেখা দরকার রাজাকারের পুত্রকন্যারা কোথাও কোনো প্রকার নেতৃত্ব জবরদখল করেছে কিনা। এগুলো জরুরি ভিত্তিতে সাফ না করলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপূর্ণ বিজয় নিশান জাতির ভাগ্যাকাশে উড়বে না। কারণ আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ দাবীদার রাজনৈতিক দলের নেতাদের মুখে অনেক অবান্তর কথা শুনি। তিরিশ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি করে তারা।
রাজাকার ও তার পুত্রকন্যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে মিশে গিয়ে পাকি চেতনা বাস্তবায়ন করতে অপচেষ্টা করবে। তাদের এই অপচেষ্টার সকল সুযোগ বন্ধ করা হোক। সেজন্য চাই রাজাকার ও তাদের পুত্রকন্যাদের দ্রুত চিহ্নিতকরণ এবং তাদের ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা গ্রহণ ও কার্যকর প্রয়োগ। এ ব্যাপারে সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উদাসীন হওয়া তাদের নিজেদের জন্যই আত্মঘাতী হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)