চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রাজনীতি ও দেশ দুটোই বাঁচাতে পারে বিজ্ঞান সাংবাদিকতা

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্ণ হয়ে ৪৬ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে উন্নয়ন ও গণমাধ্যমকর্মী মোহাম্মদ গোলাম নবী  আগামী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জন-ব্যর্থতা ও করণীয় বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন চ্যানেল আই অনলাইন পাঠকদের জন্য।  পর্ব-৯ 

স্বাধীনতার ৪৫ বছরে আমাদের দেশে সবচেয়ে কম এগিয়েছে বিজ্ঞান চর্চা। বিজ্ঞান চর্চা বাড়ুক, সে নিয়ে আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর সুনির্দিষ্ট কোনো ম্যান্ডেটও নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে অনেক কিছুই থাকে কিন্তু দেশে বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞানের সুফল কিভাবে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হবে, সে নিয়ে সেখানে দুই লাইনও লেখা থাকে না।

দেশের বিজ্ঞান চর্চা বাড়ানোর কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আমরা কোন সরকারের আমলেই দেখতে পাইনি। এমনকি দেশের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার সুস্পষ্ট চিত্রটিও দেশের জনগণের জানা নেই। স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা থেকে শুরু করে রেল, ব্রিজসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ কোনো কিছুই বিজ্ঞানের বাইরে নয়। এই যে বিদ্যুৎ নিয়ে এতো কথা হয় দেশে, সেই বিদ্যুতের সিস্টেম লস ঠেকাতে হলেও বিজ্ঞান বিষয়ে সচেতনতা দরকার। বিদ্যুতের সিস্টেম লস শুধু উৎপাদন পর্যায়ে নয়, ট্রান্সমিশন, বিতরণ এমনকি ভোক্তা পর্যায়েও হচ্ছে।

দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার স্বরূপ এবং কীভাবে এটি জনগণের কল্যাণে কাজে লাগতে পারে সে নিয়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চকিত হতে পারেন সমাজের বিবেক নামে পরিচিতি গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা। কিন্তু তারা এ বিষয়ে মোটেই সরব নন। এর বোধ হয় দু’টো কারণ: (১) জ্ঞান বিজ্ঞান বিষয়ক লেখার পাঠক সেভাবে দেশে তৈরি হয়নি। অর্থাৎ বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখার পাঠক কম। ফলে গণমাধ্যমের মালিক ও সম্পাদকরা কোনো বিষয়কে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে ও প্রকাশে কম আগ্রহী।

(২) বিজ্ঞান বিষয়কে সহজভাবে লেখার মতো সাংবাদিকের সংখ্যাও কম। তারপরও যারা আছেন তারা লিখতে পারেন না কারণ একজন সাংবাদিক কিংবা লেখককে নিত্যপ্রয়োজনীয় তেল ডাল চিনি আর লবণ কেনার অর্থ জোগাড় করতেই দিনের বড় অংশটি ব্যয় করতে হয়। তাই তার পক্ষে খুন, রাহাজানি, ধর্ষণের চেয়ে বেশি কিছু লেখা সম্ভব হয় না। এই ধরনের লেখাগুলো লিখতে সময় লাগে কম, শুধু ঘটনাস্থলে যেতে হয় কিংবা দু’চারটি ফোন করতে হয়। আরো সহজ হলো রাজনীতি নিয়ে লেখা।

অন্যদিকে বিজ্ঞান সাংবাদিকতা করার জন্যে পড়ালেখা করার দরকার হয়। নিজেকে সবসময় আপডেট রাখার দরকার হয়। গণমাধ্যমে যারা চাকরি করেন তাদের উপর লেখা তৈরির চাপটা এমনভাবে দেওয়া হয় যে, গবেষণা করে লেখার সময় তারাও পান না। আর যাদের পক্ষে গবেষণা করার সময় আছে তারা সেটি করেন না কারণ এদেশের পত্রিকা ও ব্রডকাস্ট মিডিয়াতে প্রথমত পেমেন্ট করা হয় আর্টিকেল কিংবা প্রতিবেদনভিত্তিক। সেখানে মান ও পরিশ্রমকে কদাচিৎ বিবেচনায় নেয়া হয়। তাই পেমেন্ট রেট এতটাই কম যে ওই টাকা দিয়ে একজন লেখকের পক্ষে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও ক্যালরি সংগ্রহ করাই দুস্কর হয়ে পড়ে। যে কারণে আমাদের দেশের বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির পরিমাণ দিনে দিনে কমছে।

এই ধরনের পরিস্থিতিতে দায়িত্বশীল বিজ্ঞান সাংবাদিকতাকে বিশ্বের অনেক দেশে সরকারিভাবে উৎসাহিত করা হয়। বেসরকারিভাবেও তাদের জন্য বছরব্যাপী সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় যাতে তারা মর্যাদাপূর্ণভাবে জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে সমাজ ও জনগণের জন্য যথার্থ বিজ্ঞান বার্তা উপযুক্ত সময়ে সরবরাহ করতে পারেন।

বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্য যে শুধু বিজ্ঞানীরা দেবেন আর সাংবাদিকরা লিখবেন সেটি সবসময় সত্য নয়। অনেক সময় এমন পরিস্থিতি হয়, সাংবাদিকদের লেখা থেকে জানার পর স্বাস্থ্য ও সমাজবিজ্ঞানীরা তাদের করণীয় নির্ধারণ করে থাকেন। সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়। আর সে সঙ্গে জনগণ জানতে পারেন তাদের করণীয়। সাংবাদিকরা জনগণ ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটি করতে পারেন। তারা হতে পারেন তথ্য আদানপ্রদানের সবচেয়ে বড় মাধ্যম।

বিজ্ঞান সাংবাদিকতার রাজনৈতিক দিকটিও যদি বিবেচনা করি তাহলেও বলতে হয় নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রচারে রাজনীতিবিদগণও লাভবান হতে পারেন। কারণ তারা অনেকসময় নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকায় কোনো ইস্যুতে তাদের কতটা তৎপর হওয়া দরকার সেটি বুঝে উঠতে পারেন না। যে কোনো পরিস্থিতিতে জনগণকে ভয়-ভীতি মুক্ত রাখা সম্ভব হলে দেশের উন্নয়ন সহজতর হয়। পাশাপাশি রাজনীতিবিদদের উপযুক্ত তথ্য দেয়া সম্ভব হলে তারা দেশের ও জনগণের জন্য উপকারী পদক্ষেপ ও নীতিমালা প্রণয়নে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

অনেক সময় দেখা যায়, সরকার কোনো একটি তথ্য জনগণকে দিতে ভয় পায়। যেমন ধরা যাক, বার্ড ফ্লু রোগের কথা। আপনাদের মনে থাকবে হয়তো, এশিয়াতে গত দশকে প্রথম যখন বার্ড ফ্লু দেখা দিয়েছিল এশিয়ার সরকারসমূহ বিষয়টিকে জনগণের সামনে নিয়ে আসতে চায়নি। পরে তারা অবস্থা বেগতিক দেখে জনগণের কাছে তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল। এ সময়ে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখকরা সরকারগুলোকে সহযোগিতা করেছিল। তারা এমনভাবে তথ্য উপাত্ত দিয়ে লেখা তৈরি করেছিল যে, জনগণ আতঙ্কিত না হয়ে সরকারগুলোর উপর আস্থাশীল থেকেছিল।

বাংলাদেশ বিষয়টি সেভাবে মোকাবেলা করতে পারেনি। এছাড়াও আমরা অতীতে আরো দেখেছি ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে সঠিক তথ্য প্রচারে সরকারের দিক থেকে অনীহা ছিল। পরে সরকার গণমাধ্যমে সহযোগিতা নিয়ে এবিষয়ে গণসচেতনতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। এখন কিন্তু জনগণ ডেঙ্গুতে আতঙ্কিত হয় না। এখন যেমন আমাদের দেশে যক্ষ্মা রোগী এবং এইচআইভি সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা কত হতে পারে সে নিয়ে কোনো গবেষণা ও তথ্য বের হয়ে আসছে না বিষয়টি নাজুক হয়ে যেতে পারে তেমন আশঙ্কা থেকে।

দেশে বিজ্ঞান সাংবাদিকতার প্রসার হলে সমাজের সকল অংশের মানুষ উপকৃত হতে পারবেন। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ার বিষয়টি শুধুই ইকোনমি রিপোর্ট নয়। এটি বিজ্ঞান রিপোর্টও বটে। কারণ এই দাম বাড়ার সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সে দিকটি তুলে আনার জন্য দরকার গবেষণা ও দামের সঙ্গে স্বাস্থ্যের তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন।

সবশেষে বলব, বিজ্ঞান সাংবাদিকতাকে একটি সিঙ্গেল রিপোর্ট কিংবা আর্টিকেল হিসেবে না দেখে এর পেছনের কর্মকাণ্ড এবং পরিশ্রম ও মেধা দেখার মাধ্যমে সাংবাদিকদের প্রতি মিডিয়ার নীতি নির্ধারকদের দিক থেকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত হওয়া দরকার। আর রাজনীতিকদের দিক থেকে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে লিখিত প্রতিবেদনগুলোকে সহজ মনে গ্রহণ করা দরকার।

পাঠকদের দিক থেকে এক্ষেত্রে কিছু করার নেই। কারণ এই দেশের পাঠকদের গত ৪৫ বছর ধরে নেতিবাচকভাবে সংবাদ পরিবেশন দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। আর সেই সব সংবাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে রাজনীতির ওপর। ফলে এই দেশের পাঠকদের কাছে রাজনীতি বিষয়ক খবরাখবর ও এক দলের প্রতি অন্য দলের গালাগালির যতোটা গুরুত্ব পায়, সেটি অন্য কিছুতে নয়।

এই ধরনের রিপোর্টের বিষয়ে রাজনীতিকদের দিক থেকেও চাহিদা আছে। তারাও সবসময় আলোচনায় থাকতে চান। সেই আলোচনা পজেটিভ কিংবা নেগেটিভ যাই হোক না কেন। ফলে, বিজ্ঞান সাংবাদিকতার কোন ধারা তৈরি হয়নি। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য, পুষ্টি কিংবা শিক্ষা নিয়ে রিপোর্ট হয় সেখানে গবেষণার বিষয়টি কম থাকে। বেশি থাকে ঠালাও মন্তব্য কিংবা দোষ খোঁজার প্রচেষ্টা।

দেশ যখন ৪৬ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে তখন বোধহয় আমাদের আর দেরি করা ঠিক হবে না। দেশের কল্যাণেই বিজ্ঞান সাংবাদিকতা বাড়ানোর প্রতি গণমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক ও রাজনীতিকদের মনোযোগী হতে হবে; কারণ বিজ্ঞান সাংবাদিকতা রাজনীতিক ও দেশের জনগণ দু’পক্ষকেই সমানভাবে উপকার করতে পারবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)