একেকটা নতুন বছর যেনো আশার আলো হয়ে আসে। ব্যক্তিগত ছোট ছোট চাওয়া থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতি সবখানেই নতুন বছর ঘিরে উঁকি দেয় নতুন স্বপ্ন। তাই হয়তো বর্ষবরণ উৎসবের এতো ঘটা!
সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যে উৎসবের ধরন আলাদা হলেও ইংরেজি বর্ষবরণের প্রধান অনুষঙ্গই যেনো আতশবাজি। সিডনি হার্বার, লন্ডনের টেমস নদী, ইউরোপের রাইন-সেইনের আতশবাজি উৎসব তো বিশ্বখ্যাত।
ইউরোপের কয়েক দেশজুড়ে বয়ে চলা রাইনের তীর ধরে আতশবাজির খেলা দেখার সুযোগ হয়েছিলো একবার। সেটা ২০০৮ এর ৩১ ডিসেম্বর। সে সময় কাজ করতাম জার্মানির বন শহরে ডয়চে ভেলে রেডিও-তে। অফিস শেষে দু’তিন জন সহকর্মী মিলে প্রায়ই ফিরতাম একসাথে। শপিং মলে ঘোরাঘুরি কিংবা ট্রামে চড়ে শহরের এমাথা থেকে ওমাথায় বেড়ানো হতো নিয়মিত।
৩১ তারিখ রাত ৯টার দিকে বন এর প্রধান রেল স্টেশন হপট বান হফ-এ নামলাম। উদ্দেশ্য বন সেন্টারে টো টো করা। আসলে ওখানকার দোকান, ভবন, থরে থরে সাজানো ফুলে টব সবই মনে হতো দেখার মতো। বন সেন্টার থেকে থার্টি ফার্স্ট উৎসব দেখতে চললাম রাইনের পাড়ে। সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স আর নেদারল্যান্ডস ছুঁয়েছে নদীটি। আর বন শহরকে তো দু’ভাগ করে দিয়েছে এই রাইন।
বন সেন্টার থেকে রাইন হাঁটা পথ। যেতে হয় বন ইউনিভার্সিটি হয়ে। ক্যাম্পাস দিয়ে যাওয়ার সময়ই দেখলাম দলে দলে আসছে মানুষ। কেউ আসছে জুটি হয়ে, কেউ সপরিবার। বুড়োরাই বা বাদ যাবেন কেনো? কনকনে ঠাণ্ডাতেও ঘরে বসে না থেকে খোলা আকাশের নীচে থার্টি ফার্স্ট উদযাপনে তারাও। দেখলাম বাবা-মা’র সঙ্গে স্ট্রলারে চেপে এসেছে কয়েক মাসের শিশুও!
রাত ১০টার দিকেই রাইনের দুই তীর ভর্তি মানুষে। নানা বয়সী এতো মানুষ, তারপরও কোন বিশৃংখলা নেই। নেই নিরাপত্তার বাড়াবাড়িও। অথচ সবাই কতো স্বতঃস্ফূর্ত, নিরাপত্তা নিয়ে কোন শংকা নেই কারো!
আতশবাজি উৎসব শুরু হয়ে গেলো রাত ১১টার পরই। নদীর দুই পাড়ে আকাশে যেনো রঙিন আলোর নাচন! এতো সুন্দর! আকাশে বর্ণিল খেলা। তারই প্রতিচ্ছবি নদীতে। নদী ধরে যতো দূর চোখ যায় একটু পর পরই ঝলকে উঠছে রঙিন আলো। রঙে রঙে নতুন বছরকে বরণ। অপূর্ব দৃশ্য! রাত সোয়া ১২টা পর্যন্ত চললো আলোর উৎসব। এরপর যে যার যার মতো ফিরতে শুরু করলো গন্তব্যে। মনেই হলো না কিছুক্ষণ আগেই এতো আয়োজন ছিলো রাইন ঘেঁষে।
আতশবাজি উৎসব শেষে আবারো দৌড় হপট বান হফে। ট্রাম ধরতে। স্টেশনে সে কী ভিড়! মনে হলো বন’এ এতো মানুষ এলো কোত্থেকে? যা হোক কোন রকমে উঠে পড়লাম আমার রুটের ট্রাম সিক্সটিন’এ।
দেশে দেশে বর্ষবরণ উৎসব বরাবরই নির্বিঘ্ন হয়ে আসলেও এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। যে কেনো আয়োজনে নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় থাকাটা স্বাভাবিক, তবে এবার সবকিছু ছাপিয়ে গেছে এই প্রশ্ন। যেনো আতংকে মোড়ানো আয়োজন!
প্যারিসে জঙ্গি হামলার পর অনেকটাই গুটিয়ে গেছে ইউরোপ। থার্টি ফার্স্ট ও নববর্ষ ঘিরে হামলার আশংকায় নিরাপত্তার কড়াকড়ি পুরো মহাদেশে। ইউরোপের সব দেশে নিরাপত্তা বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছে অস্ট্রিয়া পুলিশ। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ইউরোপজুড়ে হামলার ফন্দি আঁটছে আইএস। আর রাজধানী ব্রাসেলসে তো থার্টি ফার্স্টে আতশবাজি উৎসবই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে বেলজিয়াম। ক্যালিফোর্নিয়া হামলার পর বর্ষবরণ ঘিরে উচ্চ সতর্কতায় যুক্তরাষ্ট্রও। নতুন বছর ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ এশিয়াজুড়ে।
এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা কোথায় নেই আইএস আতংক? কিন্তু মানুষইতো স্বপ্ন দেখে। বিশ্বজুড়ে তাণ্ডব চালানো জঙ্গিরা আর বাড়বে না, নির্মূল হবে তারা; নতুন বছর ঘিরে এমন স্বপ্ন দেখা আকাশ-কুসুম! তারপরও সহিংসতামুক্ত শান্তির পৃথিবীর প্রত্যাশা সবার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)