চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রমজানে শিশুদের প্রতি কর্তব্য

“ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে,
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।
আকাশ-আলোর আমরা সুত,
নূত বাণীর অগ্রদূত,
কতই কি যে করবো মোরা-নাইকো তাহার অন্ত-রে….’’

মুসলিম রেনেসাঁর কবি গোলাম মোস্তফার এ কয়টি লাইন গভীরভাবে অনুধাবন করলে শিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সহজেই অবগত হওয়া যায়। কবি বলেছেন, ভবিষ্যতের বহু বড় বড় মহামানব শিশুদের মাঝেই লুকিয়ে আছে। তাদের মধ্য থেকেই অতীতে বের হয়ে আসছিলো সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ মনীষীরা। শিশু শব্দটি উচ্চারণ করলেই চোখের সামনে এক নিষ্পাপ মায়াবি চেহারা ভেসে আসে। এরা ঠিক চারাগাছের মতই। হাওয়ায় দুলতে থাকা সবুজ-শ্যামল নির্মল পাতাযুক্ত ছোট্ট চারাগাছই এদের উদাহরণ। বাচ্চারা ছোটকালে যা শেখে, পরবর্তী জীবনে সেটারই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। তাই আমাদের করণীয় হলো ছোট থেকেই গভীর পরিচর্যার মাধ্যমে তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।

শিশুদের প্রতি এ দায়িত্বভার সারা বছরই রয়েছে। তবে ভিন্ন ভিন্ন সময় কিছু বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেমন- শিশু অসুস্থ হলে তার বিশেষ যত্ন নিতে হয়। ভালো ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা করাতে হয়। গ্রীষ্মে যাতে রোদের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি না করে, সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। একইভাবে বর্ষায় যাতে বৃষ্টিতে না ভেজে, শীতকালে যাতে ঠাণ্ডা লেগে না যায়, সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হয়। এভাবে সময়ের প্রয়োজনে শিশুর পরিচর্যার বিষয়ও ভিন্ন ভিন্ন হয়। ঠিক তেমনিই রমজান মাসে শিশুদের প্রতি আমাদের বিশেষ করণীয় রয়েছে। আজ আলোচনার বিষয় সেই করণীয় বিষয়গুলো কী কী?

রমজানে শিশুদের প্রতি আমাদের করণীয়:

‘ইবাদাতের বসন্তকাল’ খ্যাত পবিত্র রমজান মাসে শিশুদের প্রতি আমাদের নানাবিধ দায়িত্ব রয়েছে। যেমন-

রোজা পালণে উদ্বুদ্ধ করা
ছোটকাল থেকে তাদেরকে রোজা পালনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কেননা ছোটবেলা থেকেই যদি তাদের ভেতর রোজার ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা না জন্মে, তাহলে বড় হয়ে তারা রোজা রাখতে উৎসাহী হয়ে উঠবে না। রমজান মাসে ইবাদতের আবহ বিরাজ করে। এ মাস গুনাহ মাফের মাস। দোয়া কবুলের মাস। শিশুরা কোনো গুনাহ না করলেও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় রোজা পালন করতে পারে। রোজা পালন শিশুর জন্যও উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর রোজা পালনে ধৈর্য ও মানসিক শক্তি বাড়ে। শিশুর রক্ত পরিশুদ্ধ হয়। শরীরের খারাপ পদার্থগুলো কিডনি অন্ত্র দিয়ে বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হয়। তাই রমজানে তাদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে বিশেষভাবে।

অনেক মা-বাবার ক্ষেত্রে দেখা যায় রোজার দিনে বাচ্চারা না খেতে চায়লেও তাদের জোর করে খাওয়ানো হয়। এটা ধর্ম ও সন্তান উভয়ের প্রতি চরম অন্যায়। কেননা হাদীসে পাকের ভাষ্য এর বিরোধী। রুবাই বিনতে মুআওয়েয ইবনে আফরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আশুরার সকালে মদিনার আশেপাশে আনসারদের এলাকায় এই ঘোষণা পাঠালেন যে, যে ব্যক্তি রোজা অবস্থায় সকাল শুরু করেছে, সে যেন তার রোজা পালন সম্পন্ন করে। যে রোজাহীন অবস্থায় শুরু করেছে সেও যেন বাকি দিনটুকু রোজা পালন করে। এরপর থেকে আমরা আশুরার দিন রোজা পালন করতাম এবং আমাদের ছোট শিশুদেরকেও রোজা রাখাতাম। আমরা তাদের নিয়ে মসজিদে যেতাম এবং তাদের জন্য উল দিয়ে খেলনা তৈরি করে রাখতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে সেই খেলনা দিয়ে ইফতারের সময় পর্যন্ত সান্তনা দিয়ে রাখতাম। (বুখারি)

দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.) রমজান মাসে এক মদপানকারীকে ধিক্কার পূর্বক বলেছিলেন, “তোমার জন্য আফসোস! আমাদের ছোট শিশুরা পর্যন্ত রোজাদার অথচ তুমি রোজাহীন” এরপর তিনি তাকে প্রহার করা শুরু করলেন (বুখারি)। এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, যে বয়সে শিশুরা রোজা পালনে সক্ষমতা লাভ করে, পিতা-মাতার উচিৎ তাকে তখন থেকেই প্রশিক্ষণমূলক রোজা রাখানো। আলেমগণের কেউ কেউ এ সময়কে ১০ বছর বয়স থেকে নির্ধারণ করলেও এটি মূলতঃ শিশুদের শারিরীক গঠনের উপর নির্ভরশীল।

এ ক্ষেত্রে কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে
(১) শিশুদের নিকট রোজার ফযিলত সম্পর্কিত কুরআন-হাদিসের বিবৃতি বর্ণনা করা। এটি পারিবারিক ভিত্তিতেও হতে পারে, আবার এলাকার মসজিদে কিংবা উন্মুক্ত কোন জায়গায় শিশুদের একত্রিত করেও হতে পারে। তাদের বুঝানো উচিত, রোজা পালন জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম। এটি ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। তাই সবাইকে রোজা রাখতে হবে।

(২) প্রথমদিকে দিনের কিছু অংশে রোজা পালন করানো। ক্রমান্বয়ে সেই সময়কে বাড়িয়ে দেয়া। এভাবে তারা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে তাদের জন্য সিয়াম পালন সহজ হয়ে যাবে।

(৩) পুরষ্কার ঘোষণা করা। বাচ্চাদের মাঝে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সাধ্যমত পুরষ্কার ঘোষণা করলে তাদের মাঝে রোজা রাখার আগ্রহ বাড়বে। কেননা পুরষ্কারের প্রতি কেবল শিশুরা না, বড়রাও ধাবিত।

(৪) সাহরি ও ইফতারের সময় পরিবারের সকল সদস্যের সামনে তাদের উচ্চসিত প্রশংসা করা। এতে করে রোজা রাখার প্রতি তাদের উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে।

(৫) তাদের মধ্যে যাদের ক্ষুধা লাগবে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে অথবা বিভিন্ন খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা। যেভাবে আমরা হাদিস শরিফ থেকে জানতে পেরেছি।

মসজিদে নিয়ে যাওয়া
শিশুদের নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও তারাবিহ পড়ার জন্য মসজিদে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এতে করে তারা নামাজ-রোজা সম্পর্কে সচেতন হবে। ক্রমান্বয়ে নামাজের বিধি-নিষেধ জানতে শুরু করবে। রমজান মাসে এটির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কেননা মসজিদগুলোতে রমজান মাসে বিশেষ মিলাদ মাহফিল ও রমজান শীর্ষক আলোচনার ব্যবস্থা থাকে।

শিশুদের জন্য মাসব্যাপী বিশেষ কুরআর ও মাসলা-মাসায়িল শিক্ষার কোর্স চালু করা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য দীনি জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরজ’। যেহেতু কুরআন দীনি জ্ঞানের প্রধান উৎস, আর যেহেতু এ পবিত্র মাসেই কুরআনের অবতরণ, তাই এ মাসে কুরআনের শিক্ষায় বিশেষ বরকত নিহিত রয়েছে। তাই আমাদের কর্তব্য হলো-সাংগঠনিক উদ্যোগে বিনা খরচে কুরআন-তাজভীদসহ অন্যান্য মাসলা-মাসায়িল ভিত্তিক বিশেষ কোর্স চালু করা, যাতে কোমলমতি শিশুরা কুরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে।

তবে এ সকল ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা উচিৎ যে, যাতে শিশুদের উপর যেন অতিমাত্রায় চাপ প্রয়োগ করা না হয়, যার কারণে দীন-ধর্মের প্রতি তাদের অনীহা চলে আসে। বাচ্চাদের ঠিক বাচ্চার মত করেই আদর-যত্নে বুঝাতে হবে। যেমনি করে চারাগাছকে খুবই সতর্কতার সহিত যত্ন করতে হয়, শিশুদের তদ্রুপ যত্ন করে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। আর এসবের উত্তম সময় যেহেতু রমজান, তাই এ মাসেই এর বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া কর্তব্য।

সুবিধাবঞ্চিত ও অবহেলিত গরীব ও পথশিশুদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া
এটি আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিশেষ কর্তব্য। আপনার-আমার সাহরি-ইফতারে থাকে বাহারি আয়োজন। কিন্তু অবহেলিত গরীব পথশিশুদের অনেকেই অনাহারে-অর্ধাহারে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করে থাকে। মানবসেবাই পরম ধর্ম। মানুষকে কষ্টে রেখে আপনার-আমার ইবাদাত-রিয়াজতের মূল্য খোদা তায়ালার নিকট কতটুকু, সেটাও একটা বিরাট প্রশ্ন থেকে যায়। রাসুলুল্লাহর হাদিসে ইরশাদ রয়েছে- “ইসলামে দুটি কাজ উত্তম। একটি সালাম প্রদান করা, অপরটি অভাবী-দুঃখী মানুষকে আহার করানো।’’ (বুখারী ও মুসলিম)

আসুন, এ মহান রমজান মাসে শপথ গ্রহণ করি- আমরা নিজেদের সন্তানের সঠিক পরিচর্যার পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত অসহায় ও গরিব শিশুদের প্রতিও যত্নবান হবো। আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রত্যেককে সে তাওফিক দান করুন। আমিন!