জিম্বাবুয়ের সেনাবাহিনী রাজধানীর রাজপথ দখল এবং প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবেকে সরিয়ে নেয়ার ঘটনাকে ‘প্রেসিডেন্ট মুগাবে ও তার পরিবারকে নিরাপদ রাখা এবং প্রেসিডেন্টের আশপাশে থেকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানোদের ধরার অভিযান’ বলে দাবি করছে। কিন্তু আফ্রিকান আঞ্চলিক সংগঠন আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) বলছে, দেখে মনে হচ্ছে এটি সেনা অভ্যুত্থান।
সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে স্থানীয় বেশ কিছু গণমাধ্যমের করা প্রতিবেদন সত্যি হলে এর অর্থ হলো, এর মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটছে ৯৩ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট মুগাবের ৩৭ বছরের দীর্ঘ আলোচিত-সমালোচিত শাসনের।
কিন্তু কে এই রবার্ট মুগাবে, আর কীভাবেই বা মার্কসীয় আদর্শের এক স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা সময়ের স্রোতে নিষ্ঠুর স্বৈরাচারীর খেতাব পেলেন?
শুরুটা যেভাবে
রবার্ট গ্যাব্রিয়েল মুগাবের জন্ম হয় ১৯২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানী হারারের পশ্চিমে অবস্থিত কুটামায়। ফোর্ট হেয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রি নেয়ার পরও লন্ডন ইউনিভর্সিটিসহ আরও কয়েকটি দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তিনি।
লেখাপড়া শেষে তৎকালীন সাউদার্ন রোডেশিয়া এবং প্রতিবেশি দেশগুলোর বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেন মুগাবে। এর মাঝেই ঢোকেন রাজনীতিতে। ১৯৬০ সালে মুগাবে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। তার পরের বছরই তাকে জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান পিপল’স ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। দলটি পরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
১৯৬২ সালে তাকে রাজনৈতিক কারণে আটক করা হয়। আর এর পরের বছরই তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (জানু) নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে এর মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৬৪ সালে মুগাবেকে আবারও বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়। তবে ১৯৭৪ সালে অবশেষে তিনি জেল ভেঙে পালিয়ে মোজাম্বিক চলে যান। সেখান থেকেই ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সাউদার্ন রোডেশিয়ার স্মিথ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন রবার্ট মুগাবে।
ক্ষমতার শুরুর কথা
রবার্ট মুগাবে ১৯৮০ সালে জিম্বাবুয়ের সরকারপ্রধান হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এর আগ পর্যন্ত সাউদার্ন রোডেশিয়া (স্বাধীনতাপূর্ব জিম্বাবুয়ের নাম) ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি উপনিবেশ। অঞ্চলটির শ্বেতাঙ্গ শাসক ইয়েন স্মিথ ও তার শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে টানা ১৪ বছর বিদ্রোহ ও লড়াই চালিয়ে জয় পান মুগাবে।
লর্ড ক্রিস্টোফার সোমসের মাধ্যমে আয়রন লেডি বলে খ্যাত নবনির্বাচিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ১৯৭৯ সালে ইয়েন স্মিথের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বন্ধ করতে একটা সমঝোতা চুক্তি করানোর চেষ্টা করেন। সবাই অবাক হয়ে দেখল, মাক্সবাদের মতাদর্শে চলা কট্টর স্বাধীনতাকামী, নিজের আদর্শে দৃঢ় রবার্ট মুগাবে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকার শর্তসহ স্বাধীন জিম্বাবুয়ে নিয়ে এলেন। ’৮৮ থেকে তিনি হলেন জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বাধীন জিম্বাবুয়ের দায়িত্ব নেয়ার সময়েই মুগাবে কথা দেন রাজতন্ত্র ও ঔপনিবেশিকতার শাসনে থাকা অঞ্চলটিকে গণতন্ত্রের আওতায় আনার। এমনকি বিদেশি বিনিয়োগ আনতে উদগ্রীব নতুন রাষ্ট্রের নবগঠিত সরকার ঘোষণা করল, শ্বেতাঙ্গ কৃষকরা নতুন জিম্বাবুয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের কিছু সময় পর থেকেই পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে যেতে থাকে। মুগাবে যাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন বা যাদের শত্রু মনে করতেন তাদেরকে সাফ করে ফেলা হতে থাকে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর দায়িত্ব নেয় স্মিথ শাসনের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে মুগাবের পাশে থাকা বিশ্বস্ত ‘অভিজ্ঞ’ লোকজন।
এই বিশ্বস্ত সঙ্গীরা জিম্বাবুয়ের শেতাঙ্গ কৃষকদের ঘরবাড়ি ও জমিতে প্রায়ই হামলা ও লুটপাট চালাত, জমি কেড়ে নিত, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত, এমনকি কৃষকদের হত্যাও করত।
কমনওয়েলথের সঙ্গে বিচ্ছেদ
কমনওয়েলথের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট মুগাবের সম্পর্ক ছিল সবসময়ই উত্থানপতনে ভরা। এই সম্পর্ককে তিনি ‘অ্যাংলো-স্যাক্সন অপবিত্র মিত্রতা’ বলে ব্যঙ্গ করতেন।
নির্বাচনে ব্যাপক আকারের ভোটচুরির অভিযোগে মুগাবের তীব্র নিন্দা করে ২০০২ সালের মার্চে জিম্বাবুয়ের কমনওয়েলথ সদস্যপদ সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এর পরের বছর সংগঠনটির সদস্য দেশগুলোর প্রধানদের সম্মেলনে জিম্বাবুয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক চলার সময় ক্ষিপ্ত হয়ে কমনওয়েলথের সদস্যপদ ছেড়ে দেন তিনি।
এরপর…
বয়স যখন ৭০-এর কোঠায়, মুগাবের মনে ক্ষমতার পাশাপাশি জীবন হারানোর ভয় বাসা বাঁধতে লাগল। তার মনে হতে থাকে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিরা তখন আবার মুগাবের সেই বিশ্বস্ত ‘যুদ্ধসঙ্গী’দের মারধর ও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে শুরু করে। কখনো আবার এই প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি বা সমকামিতার অভিযোগ এনে পুরে দেয়া হতো জেলে।
এমনকি কোনো পত্রিকা স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশের নমুনা দেখালে সেটাও বন্ধ করে দেয়া হতে থাকে।
খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটির অর্থনীতিতে সময়ের সাথে সাথে উন্নতির বদলে বিশৃঙ্খলা এবং ধস নামতে থাকে। মুগাবে শাসনে শত কোটিপতি হয়েছেন অনেকে। অন্যদিকে সমাজের বাকি অংশে দারিদ্র্য বাড়তে বাড়তে তীব্র খাদ্যাভাবে পৌঁছে যায়।
এর মাঝে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকে ব্যাপকভাবে। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক এত বেশি পরিমাণে নোট ছাপিয়ে ফেলে যে, জিম্বাবুয়ান ডলারের দাম অতিরিক্ত কমে তীব্র মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিলের তথ্য অনুসারে, তখন মুদ্রাটির মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছিল ৫শ’ বিলিয়ন শতাংশ! এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে এই মুদ্রা বাতিল করে বন্ড নোট নামে নতুন মুদ্রা চালু করতে হয় সরকারকে।
নাইট খেতাব ছুঁড়ে ফেলা, চীনের বিকল্প নোবেল পাওয়া
২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর রবার্ট মুগাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্রের প্রতি ‘চরম অবজ্ঞা’র অভিযোগ আনলে মুগাবে ১৯৯৪ সালে পাওয়া সম্মানসূচক নাইট খেতাব ফিরিয়ে দেন। রাণী এলিজাবেথ এই খেতাব বাতিল অনুমোদন করেন।
তবে অনেকের চোখেই এরপরও হিরো ছিলেন মুগাবে। ২০১৫ সালের শেষ দিকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের বিকল্প চীনের কনফুসিয়াস শান্তি পুরস্কার পান তিনি। অনুপ্রেরণামূলক জাতীয় নেতৃত্বের কারণে তাকে এই সম্মাননা দেয়া হয় বলে জানায় নির্বাচক কমিটি।
নতুন মোড়
আপাতদৃষ্টিতে প্রেসিডেন্ট মুগাবে সপরিবার গৃহবন্দী হওয়া এবং সেনাবাহিনী রাজধানী দখলে নিয়ে রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে বিবৃতি দেয়া- এসব ঘটনার পর পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করেছে ফার্স্ট লেডি গ্রেস মুগাবের সম্প্রতি বরখাস্ত উপ-রাষ্ট্রপতি এমারসন নাঙ্গাগওয়ার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার খবর। অনেকেরই সন্দেহ, উচ্চাভিলাষী গ্রেস লতায় পাতায় হয়ে উঠতে পারেন জিম্বাবুয়ের নতুন প্রেসিডেন্ট।