আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবগাঁথা দিন এটি। এইদিনে বাঙালি জাতি পেয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, একটি ভূখণ্ড, একটি মানচিত্র, একটি পতাকা।
জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের এই দিনে বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
এবারের বিজয় দিবস পালিত হয় ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। শোক আর রক্তের ঋণ শোধ করার গর্ব নিয়ে উজ্জবিত জাতি দিবসটি পালন করে অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে। অফুরন্ত আত্মত্যাগ এবং রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই মহান বিজয়ের ৪৪ বছর পূর্ণ হলো আজ।
দেশের শ্রেষ্ঠসন্তান বুদ্ধিজীবী এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে এই স্বস্তি নিয়ে কৃতজ্ঞ জাতি সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছে দেশের পরাধীনতার গ্লানি মোচনে প্রাণ উৎসর্গ করা বীর সন্তানদের। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার সাথে শহীদের উদ্দেশে নিবেদন করা হয় পুষ্পাঞ্জলি। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সব প্রান্তের মানুষ অংশ নেয় বিজয় দিবসে।
মহান বিজয় দিবসে উপলক্ষে পৃথক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতীয় সংসদে বিরোধীদলের নেতা রওশন এরশাদ দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এ ছাড়াও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
বিজয় দিবসের বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক গৌরবময় অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ ন’মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা এ দিন চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি।’
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, দীর্ঘ ন’মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে তা পরিপূর্ণতা পায়।
মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয় গভীর শ্রদ্ধার সাথে তিনি তাদের স্মরণ করেন।
বিজয় দিবসের বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করার আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের বিজয় দিবসে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির অনন্য গৌরবের দিন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি দীর্ঘ তেইশ বছর রাজনৈতিক সংগ্রাম ও নয় মাস মরণপণ যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের এই দিনে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।
তিনি আরো বলেন, জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখে ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এমপি মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে তার বাণীতে বলেন, পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙালি জাতির বীরত্বের আত্মপ্রকাশ এবং এদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম গৌরব ও অহঙ্কারের দিন ১৬ ডিসেম্বর।
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ, নিপীড়ন, দুঃশাসনের কুহেলিকা ভেদ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বাঙালী জাতি প্রকৃতঅর্থে স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করেছিল। এ দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার বাহিনী এবং এদেশীয় তাদের দোসরদের পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। এর ফলে বিশ্বের মানচিত্রে একটি গর্বিত জাতি হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। বাঙালি জাতি যত দিন বেঁচে থাকবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গৌরব করবে, অহংকার করবে।
মহান বিজয় দিবসের বাণীতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেন, দেশে এখন মানুষের নাগরিক স্বাধীনতা নেই ও বর্তমান পরিস্থিতি যেন ‘ভয়ঙ্কর নৈরাজ্যময়’বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া।
‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং গণতন্ত্রকে বিপদমুক্ত করতে’ মহান বিজয় দিবসের প্রেরণায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে দেশবাসীর প্রতি আহবান জানিয়েছেন তিনি।
বিজয় দিবস সরকারি ছুটির দিন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপ জাতীয় পতাকায় সজ্জিত করা হবে। রাতে গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় করা হবে আলোকসজ্জা। হাসপাতাল, কারাগার ও এতিমখানাগুলোতে উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হবে। সংবাদপত্র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবে, বেতার ও টিভি চ্যানেলগুলো সম্প্রচার করবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
কর্মসূচি: প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসটির সূচনা হয়। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তববক অর্পণের মাধ্যমে একাত্তরের শহীদদের শ্রদ্ধা জানান। বিরোধীদলের নেতা রওশন এরশাদ অনুরূপভাবে সাভারে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন।
সকাল দশটায় জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হবে বিজয় দিবস কুচকাওয়াজ। এতে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন।
এছাড়াও বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, সিপিবি, ওয়াকার্স পার্টি, গণফোরামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়, বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ রাজধানীর বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করে।
এর মধ্যে ছিলো জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আওয়ামী লীগের দু’দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারাদেশের সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী মহান বিজয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৬টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত ঢাকার পুরাতন বিমান বিন্দর (রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্ত) জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে ৩১ বার তোপধ্বনি, সকাল ১০টায় জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বিজয় দিবস কুচকাওয়াজ। এতে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।