চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রক্তপাতের শঙ্কায় এরশাদকে গ্রেফতারে সেনাবাহিনীর সায়

এরশাদের বোঝা আর টানতে রাজি না হয়ে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করলেও সেনাবাহিনী তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে চায়নি। এমনকি এরশাদের মতো সেনাবাহিনীও দূরতম কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি যে পদত্যাগের পর সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদকে গ্রেফতারের মতো তিক্ত এবং বিব্রতকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার আগে অবশ্য শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করেছিল সেনাবাহিনী। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দূতিয়ালির ভূমিকা পালন করেন সেসময় রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মনজুর রশীদ খান।

এরশাদকে সরে যেতে বাধ্য করার পেছনে জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে যে সেনা কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাদের একজন তখনকার ডিরেক্টর (মিলিটারি অপারেশন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতিক। পরে ১৯৯৬ সালে যশোরের জিওসি থাকার সময় সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম, বীর বিক্রমের আদেশ মানতে গিয়ে তাকে মেজর জেনারেল হিসেবে অবসরে যেতে হয়। এখন একজন রাজনীতিক হিসেবে তিনি রাজনীতির সদর-অন্দর দেখলেও ৯০ সালে রাজনীতির অঙ্গনটা তার একেবারেই অচেনা ছিল। সেসময়ের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে চ্যানেল আই অনলাইনকে ইবরাহিম বলেন, ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন এরশাদ। কিন্তু এরশাদের বিদায়ে কে নেবেন নির্দলীয় সরকারের দায়িত্ব? প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের আগে এটা ছিলো বিরাট এক প্রশ্ন।

সব পক্ষ মিলে কারও ব্যাপারেই একমত হতে পারছিল না। ঠিক সেই সময়ে দৃশ্যপটে আসে ওই সময়ের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহেমেদের নাম।

৯০’র ৪ ডিসেম্বর এরশাদ যখন ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দেন তখন বিষয়গুলো খুব কাছ থেকে দেখেছেন ওই সময়ের তরুণ সাংবাদিক এবং এখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ফজলুল বারী। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনটি জোট মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তবে এই জোটগুলোর নিজেদের মধ্যেও কিছু কিছু সমস্যা ছিল। বিতর্কও কম ছিল না তাদের মধ্যে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় ও বিএনপি নেতৃত্বধীন ৭ দলীয় জোটের মধ্যে মাঝেমধ্যেই বৈরিতা সৃষ্টি হতো। এক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করতেন ইনু-মেননের ৫ দলীয় জোট। ইনু-মেননরা মূলতঃ নেগোশিয়েটরের ভূমিকা পালন করতেন।

justice-sahabuddin
বিচারপতি সাহাবুদ্দিন

‘শেষ পর্যন্ত তিন রাজনৈতিক জোটই বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের ব্যাপারে একমত হলো। কিন্তু বেঁকে বসলেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ নিজে। তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। কেননা সংবিধান অনুযায়ী একবার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর তার আর প্রধান বিচারপতির আসনে ফিরে আসার সুযোগ ছিল না,’ এভাবে তখনকার জটিল পরিস্থিতি বর্ণনা করে তিনি বলেন, এখন বিষয়টা যত সহজ মনে হচ্ছে তখন বিষয়টা ছিল তার চেয়ে অনেক জটিল। একদিকে এরশাদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন, তার সব মন্ত্রী-এমপিরা পালিয়ে গেছেন, রাস্তায় লাখ লাখ মানুষ, দেশে সরকার বলতে কিছু নেই, সুতরাং যতো দ্রুত একজন সর্বসম্মত রাষ্ট্রপতি নাম ঠিক করে তার শপথের ব্যবস্থা নেওয়া যাবে দেশের জন্য ততোই মঙ্গল।

ফজলুল বারী জানান, বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাজি করাতে তিন জোট থেকে তিনজন নেতা ভূমিকা রাখেন। বলা যায় তার দূতিয়ালির ভূমিকা পালন করেন। ৮ দলীয় জোট থেকে তখনকার আওয়ামী লীগ এবং পরের গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন, ৭ দলীয় জোট থেকে ছিলেন মেজর জেনারেল (অব). মাজিদ-উল-হক এবং ৫ দলীয় জোটের পক্ষে ভূমিকা রাখেন হাসানুল হক ইনু।

প্রধান বিচারপতি হিসেবে সাহাবুদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১ জানুয়ারি, ১৯৯০। তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিলো ৩১ জানুয়ারি, ১৯৯৫।

এ প্রসঙ্গ টেনে ফজলুল বারী বলেন, ‘অল্প সময়ের জন্য তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে চাচ্ছিলেন না। কেননা আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য তার প্রধান বিচারপতি থাকার সুযোগ আছে। শেষ পর্যন্ত আবারও প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ফিরে আসতে পারবেন এ শর্তে নিরপেক্ষ সরকারের দায়িত্ব নিতে রাজি হন সাহাবুদ্দিন আহমেদ।’

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম

৬ ডিসেম্বর, ১৯৯০ দায়িত্ব নেওয়ার পর ৯ অক্টোবর ১৯৯১ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন (পরে ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন কালে তিনি আরেক দফা রাষ্ট্রপতি হন)। ৯১’র ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার পর খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার সংবিধানে একাদশ সংশোধনী এনে আবারও তাকে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়।

তবে তার অনেক আগে গ্রেফতার হন সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এইচ এম এরশাদ। সাবেক ছাত্রনেতা শফী আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করলেও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দাবি ছিল তাকে গ্রেফতার করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের দায়ে বিচার করতে হবে। ১০ ডিসেম্বর সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য তার গ্রেফতারের দাবিতে বিশাল মিছিল করে। শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার হন এরশাদ।

ওই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন: যখন তিনি পদত্যাগ করলেন তখন আইনের দৃষ্টিতে তিনি ক্ষমতাহীন। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে তিনি ক্ষমতাহীন না। একটা বটগাছেরও তো শুকিয়ে মরতে অনেক বছর লাগে। তিনি ক্ষমতা ছাড়ার পর নতুন ক্ষমতায় কারা আসবে এবং ক্ষমতা কোনদিকে যাবে এসব অনিশ্চিত ছিল। আর সেটা ঠিক হয়ে যাওয়ার পর তখনকার রাজনৈতিক জোটগুলো বারবার দাবি জানাচ্ছিলো তাকে যেন বন্দী করে বিচারের মুখোমুখি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

‘সেনাবাহিনী এরশাদকে তার শাসন দীর্ঘায়িত করার জন্য সহযোগিতা করে নাই সেটা যেমন সত্য তেমনি মনস্তাত্বিকভাবে এটাও সত্য যে আমরা কামনা করছিলাম না, দেশের একজন সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান বা রাষ্ট্রপতি হেনস্তা হোক। যেটাই হোক বিচার বা তদন্ত, সেটা যেন সুষ্ঠুভাবে তদন্তের মাধ্যমে হোক। সেজন্য তাকে তার বাসস্থানেই প্রথমে সীমাবদ্ধ করা হয়। সেটা অবশ্যই গ্রেপ্তার নয়। আপনি নিজ গৃহেই অবস্থান করুন এমনটাই ছিলো আবেদন,’ বলে জানান সেসময়ের মিলিটারি অপারেশন্সের পরিচালক।

তবে, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে অব্যাহত চাপের মুখে কীভাবে সেনাবাহিনীকেও তার গ্রেফতারের পক্ষে আসতে হলো সেকথা জানিয়েছেন তিনি। ইবরাহিম সরাসরি না বললেও অন্যরা জানিয়েছেন, এর এক কারণ তখনও সেনাবাহিনীর ভেতরে এরশাদের পক্ষের কয়েকজনের নড়াচড়ার চেষ্টা এবং অন্য কারণ সেনাবাহিনীকে উস্কানি দিতে তখনও ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে নিজের বাসভবনে অবস্থান করা এরশাদের নিজের চেষ্টা।

সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. (অব.) নূর উদ্দিন খান
সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. (অব.) নূর উদ্দিন খান

জেনারেল ইবরাহিম বলেন: সাতদিন চলে যাওয়ার পর সবাই চিন্তা করলো, ১৯৭৫ সালে নানান দুঃখজনক ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে সেটার পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না। ক্ষমতা যেহেতু ছেড়ে দিয়েছেন তাই তাকে কতদিন সেনাবাহিনী নিরাপত্তায় রাখবে! তাই তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ চিন্তাভাবনা করে বললেন, আমরা আলাদা বাড়িতে তাকে নিয়ে যাবো এবং সেটাকে সাবজেল ঘোষণা করবো। সেই মোতাবেক তাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে গুলশানের একটি বাড়িতে নিয়ে রাখা হয় এবং সেটাকে সাবজেল ঘোষণা করা হয় আইন মোতাবেক। বাংলাদেশ সরকার চাইলে কোনো না কোনো জায়গাকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত জেলখানাগুলির বর্ধিতাংশ হিসেবে ঘোষণা করতে পারে এবং সেখানে জেলখানার নিয়মকানুন প্রযোজ্য হবে।’

সেভাবেই গুলশানের একটি বাড়িকে সাবজেল ঘোষণা করে এরশাদ, বেগম রওশন এরশাদ এবং তাদের ছেলে সাদ এরশাদকে ওই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতারের সময় এরশাদের ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে থাকা অবৈধ অনেক কিছু জব্দও করে পুলিশ। পরে অবশ্য এরশাদকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। বিভিন্ন মামলায় বিচার চলতে থাকে তার।

একানব্বই’র নির্বাচনের মতো ৯৬’র নির্বাচনেও এরশাদ রংপুর অঞ্চলের পাঁচটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান। এর আগেই অবশ্য জাতীয় সংসদ ভবন সংলগ্ন একটি বাড়িকে সাবজেল ঘোষণা করে তাকে সেখানে নিয়ে আসা হয়েছিল। মুক্তির পর ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ের জনসভায় সেসময়ের আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সমর্থনের কথা জানালেও ততোদিনে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে গিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে জ্বালানিমন্ত্রী হওয়া জেনারেল নূর উদ্দিন খানের বিষয়ে সমালোচনামুখর বক্তব্য রাখেন এরশাদ। ওই নির্বাচনের আগে নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে একটি পা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনাকে মনে করিয়ে দিয়ে সাবেক সেনাপ্রধান নূর উদ্দিন খানকে এরশাদ একটি আপত্তিকর বিশেষ নামে অভিহিত করেন।

90-revolution-4এখনো ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজের পর কোরআন তেলাওয়াত করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে মনোনিবেশ করা জেনারেল নূর উদ্দিন খানকে এরশাদ হয়তো কখনোই ‘ক্ষমা’ করবেন না। কারণ নূর উদ্দিন খানের নেতৃত্বে সেদিনের সেনাবাহিনী রক্তপাত এড়াতে জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল বলেই ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে দিয়ে বন্দুকের নলের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা এরশাদকে ৯০’র ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছিল। তবে, এদেশের রাজনীতিক, সেসময়ের ছাত্রনেতা, ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের নায়করা জেনারেল নূর উদ্দিন খানকে সবসময়ই ধন্যবাদ জানান। একদিকে স্বৈরশাসক এরশাদের ক্ষমতার জন্য রক্তপাতে না যাওয়া, কারো কারো মতে সুযোগ থাকার পরও সামরিক শাসন জারি না করা এবং প্রবল এক গণঅভ্যুত্থানের সময় শান্তিপূর্ণ পট পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা মানুষটিকে মনে রাখবে না ইতিহাস?

(১৯৯০ সালে ছাত্রগণঅভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদকে বিদায় করা রাজপথের আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছে পুরো বাংলাদেশ। যেভাবে এ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে এবং তার কিছু নেপথ্য ঘটনাও অনেকের জানা। তবে, সেনাবাহিনী সমর্থন প্রত্যাহার করায় যেভাবে জেনারেল এরশাদ পায়ের নীচে মাটি হারিয়ে ফেলেন সেই ঘটনা জানা নেই বেশিরভাগ মানুষের। ৯০ সালের উত্তাল সময়ে রাজপথের পাশাপাশি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে কী ঘটছিল সেই অজানা অধ্যায়গুলো তুলে ধরা হয় ধারাবাহিক এ প্রতিবেদনে। আজ প্রকাশিত হলো ধারাবাহিকটির শেষপর্ব।)