রংপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ বুদ্ধিজীবী লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল কাদির স্মৃতিস্তম্ভের বাগানবাতি ভেঙে দিয়েছে দুস্কৃতিকারীরা। শুক্রবার দিবাগত রাতে বাগানবাতিগুলো স্মৃতিস্তম্ভকে আলোকিত করলেও সকালে তা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগের প্রস্তুতি নিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ বুদ্ধিজীবী লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল কাদিরের ছেলে সাংবাদিক নাদীম কাদির।
জানা যায়: রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের মোস্তাফাপুর গ্রামের আবুল হোসেন মিয়ার সন্তান শহীদ লেফট্যানেন্ট কর্নেল আবদুল কাদির। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তার নামেই নাটোরের কাদিরাবাদ সেনানিবাসের নামকরণ হয়। ১৯২৯ সালের ২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন কর্নেল কাদির। ১৯৪৯ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে যোগ দেন। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে অবদান রাখতে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে তৎকালীন অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান হিসেবে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন তিনি। স্বাধীনতাকামী বাঙালি অফিসারদের সাথে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে তিনি ১৯৬৮ সাল থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বেশ কয়েকবার গোপনে দেখা করেছিলেন। মার্চ মাসে তিনি বঙ্গবন্ধুর তহবিলে ১০ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করে তা পাকিস্তান রেডিওতে ঘোষণা করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ডেভেলপমেন্ট স্টোর থেকে বিস্ফোরক ও জনবল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেন তিনি। তিনি সহকর্মী অফিসারদের কাছে বিস্ফোরক হস্তান্তর করেছিলেন। সেগুলো দিয়ে মুক্তিকামী মানুষ শুভপুর ব্রীজসহ রাস্তা এবং সেতু উড়িয়ে দিয়ে চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রবেশ বিলম্বিত করেছিল। একাত্তরের মার্চের প্রথম দিকেই কর্ণেল কাদির নিজ বাসায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিপরীতে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ৭০ নম্বর সরকারি বাড়িতে পরিবারসহ বসবাস করতেন। স্ত্রী হাসনা হেনার সঙ্গে দেখা করতে আসার সংবাদ পাকিস্তানি সেনারা জানতে পেরে ১৭ এপ্রিল তাকে চট্টগ্রামের ওই বাসা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। ১৭ এপ্রিল বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন কর্নেল কাদির। ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে তার কবর খুঁজে পায় পরিবার। ২০১১ সালে তার মরদেহ তার নামে করা নাটোরের কাদিরাবাদ সেনানিবাসে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পুনঃসমাহিত করা হয়।
এরপর কর্নেল আবদুল কাদিরের ছেলে সাংবাদিক নাদীম কাদির পৈত্রিক জমিতে তার বাবাসহ মুক্তিযুদ্ধে বদরগঞ্জে শহীদদের নামে নিজ উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেন এবং চিকলী নদীর তীরে আধুনিক নকশা অনুযায়ী দৃষ্টিনন্দন একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলেন। শুক্রবার দিবাগত রাতে সাংবাদিক নাদীম কাদির আগামী ৮ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধনের ঘোষণা দেন। কিন্তু এরই মধ্যে স্বাধীনতা বিরোধী দুস্কৃতিকারীরা স্মৃতিস্তম্ভের বাগানবাতি ভেঙে দিয়েছে।
এ নিয়ে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। বর্তমান সরকারের আমলে দেশবিরোধীরা কিভাবে দেশের সূর্যসন্তানদের স্মৃতিস্তম্ভের উপর হামলা চালায় সেই প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
কর্নেল আবদুল কাদিরের ছেলে সাংবাদিক নাদীম কাদির বলেন: মূল সড়ক থেকে মানুষরা যেন স্মৃতিস্তম্ভটিকে দেখতে পায় সেজন্য এর চারপাশে বাতি স্থাপন করা হয়েছিল। শনিবার সকালে আমরা স্মৃতিস্তম্ভের চারদিকের বাগানবাতিগুলো ভাঙা অবস্থায় পাই। এটি যারা করেছে তারা দেশবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী। তারা চায় না দেশের সূর্য সন্তানদের স্মৃতিচিহ্ন থাক। আমি তাদের শাস্তি কামনা করছি।
এ ব্যাপারে বদরগঞ্জ থানার ওসি হাবীবুর রহমান হাবীব বলেন: খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়েছি। তারা তদন্ত করছে। এ নিয়ে এখনও কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তদন্তের আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।