‘উই আর ইন দ্যা ট্রুথ টেলিং বিজনেস।’ সকালে প্লেনারি সেশনে তার বক্তব্য মাথায় ঘুরছিলো পুরো দিন জুড়ে। তাই সন্ধ্যায় এলবে নদীর বোট ট্রিপে যখন দেখা, সরাসরি প্রশ্ন, ‘সত্য বলার এই কাজ কতটা করতে পারছি আমরা?’ মৃদু হাসিমাখা উত্তর, ‘হয়তো পুরোপুরি পারছি না। বিশ্বজুড়েই এই প্রবণতা চলছে। একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক যা করতে চান, কোনো সরকারই তার অনুমতি দেবে না। এর সঙ্গে নতুন ঝুঁকি হয়ে এসেছে, ব্যবসায়িক গোষ্ঠী আর উগ্রজাতীয়তাবাদ। কিন্তু চেষ্টাতো চালিয়ে যেতে হবে। নিশ্চয়ই অবস্থার পরিবর্তন হবে। সবখানে, তোমার বাংলাদেশে, আমার পাকিস্তানে।’
পাকিস্তানে গত প্রায় তিন দশক ধরে সত্য বলার এই যুদ্ধটা যিনি চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি জাফর আব্বাস। উপমহাদেশের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্য ডন সম্পাদক। ২৬ সেপ্টেম্বর, সন্ধ্যার পুরো দেড়টি ঘণ্টা যিনি ব্যয় করলেন, বাংলাদেশের দুই তরুণ সাংবাদিকের পেশাগত হতাশা দূর করতে। জাহাজ থেকে নামার সময় বলে গেলেন, ‘সত্য বলার দায়ে, সরকার তোমার নামে দেশদ্রোহীর তকমাও লাগিয়ে দিতে পারে। কিন্তু হাল ছেড়ো না। টানেলের শেষ প্রান্তের আলো ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে।’
এমন আশার কথা শোনা গেল ডেভিড কাপলানের কন্ঠেও। ডেভিড স্বাধীন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ধারণার অন্যতম প্রবর্তক। গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক। সাংবাদিকতায় ২৫টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া এই মার্কিনী মাউথ ওরগানও বাজান দারুণ। সে গল্প পরে হবে, আগে যাওয়া যাক হামবুর্গের হাফেনসিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হোলসিম হলে। যেখানে গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে হাজির বিশ্বের ১৩০টি দেশের প্রায় ১৭শ’ সাংবাদিক আর এই পেশা সংশ্লিষ্টরা।
বিশাল এই জমায়েত দেখেই হয়তো ডেভিড কাপলান বলে উঠলেন, ‘লড়াইটা আরো জমবে। এখন আরো অনেক বেশি অনুসন্ধানী সাংবাদিক আসছেন। তৈরি হচ্ছে নতুন এক প্রজন্ম, যারা উন্নত সব প্রযু্ক্তি ব্যবহার করছেন।
প্রযুক্তির ব্যবহার যে আগামীর সাংবাদিকতায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা গেল এবারের কনফারেন্সের সেশন তালিকা দেখে। ২৫০টি সেশনের মধ্যে প্রায় ৬৩টিই ছিল প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট। যেখানে হাতে কলমে শেখানো হয়েছে, স্প্রেডশিট-পাইথনের মতো ডেটা জার্নালিজমের কৌশল থেকে শুরু করে অনলাইন সার্চিং, ভুয়া তথ্য যাচাই আর স্যাটেলাইটের ছবি ব্যবহার করে অনুসন্ধানের সুযোগ। আর তা প্রতিবেদনে সহজ আর সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য ছিল ডেটা ভিজুয়ালাইজেশনের মতো সেশন। যেখানে বলা হয়, ‘ততটাই সহজ গ্রাফিক তৈরি করুন, যতটা সম্ভব। কেননা, ৮০ ভাগ দর্শক এমন সংবাদ মনে রাখে, যেখানে তথ্য গ্রাফিক আকারে প্রকাশ পায়। বাকি ২০ ভাগ দর্শক, শুধু সংবাদ পড়েই তথ্য মনে রাখার মতো কঠিন কাজটি করতে পারেন।’
আর টেলিভিশন সাংবাদিকতায় ছবির গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে, কানাডার সিবিসি নিউজের সিনিয়র ডিরেক্টর (ইনভেস্টিগেটিভ) ম্যারি ক্যালোজ বললেন, ‘বেশি ছবি দেখান, বলুন কম (শো মোর, টেল লেস)।’ তার পরামর্শ ছিল, বর্তমান কালে গল্প বলার।
তবে গল্প বলার প্রথাগত সব ধরণও পাল্টে যাচ্ছে একটু একটু করে। নরওয়ের সংবাদ মাধ্যম ভিজির ‘টিন্ডারের প্রতারক’ প্রতিবেদনটি পড়া ছিল আগেই। কিন্তু শুধু স্মার্টফোন ব্যবহার করে কিভাবে পুরো অনুসন্ধানটি তৈরি হলো, তা জানা গেল চেঞ্জিং আর্ট অফ স্টোরি টেলিং-এর সেশনে আর্লেন্ড আর্ন্টসেনের কাছে। পরামর্শ দিলেন, ‘অনুসন্ধানে সঙ্গী করুন দর্শককে। গল্প বলার ধরণ নির্ধারণের আগে ভাবুন, কে আপনার দর্শক। তিনি কিভাবে গ্রহণ করবেন সংবাদটিকে। মাধ্যমই বা কী হবে।’
শুধু প্রতিবেদন নয়, কৌশল বদলেছে সাক্ষাৎকার গ্রহণেরও। সাক্ষাৎকারদাতাকে চমকে দিতে ব্যাক অ্যান্ড ফোর্থ বা আগে-পিছে স্টাইলে প্রশ্ন করার পরামর্শ দিয়েছেন সিবিসি নিউজের সিক্সটি মিনিটসের প্রযোজক ওরিয়ানা জিল। তবে অনুসন্ধান শুরুর প্রক্রিয়া সব দেশ আর সব সমাজেই এক। এমনটাই মনে করেন, মার্ক লি হান্টার। বিখ্যাত এই অনুসন্ধানী সাংবাদিক, স্টোরি বেইজড ইনকোয়ারি অ্যাসোসিয়েটসের প্রতিষ্ঠাতা। যদিও জিআইজেএন এর ব্যান্ড মাকর্যাকার্সের লিড গিটারিস্টের পরিচয়টাও কম সুনামের নয়।
তার মতে, ‘অনুসন্ধানের শুরু হওয়া উচিৎ উত্তর দিয়ে, প্রশ্নে নয়। সেই হাইপোথিসিস বা অনুমানের সত্যতাই অনুসন্ধান করা হবে পরবর্তী সময়ে। অনুসন্ধানের সূত্রও গাঁথা থাকবে, ওই উত্তর বা অনুমানে।’ কাঠামো মেনে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির ডজন খানেক গ্রন্থ আছে মার্ক লি হান্টার আর তার স্টোরি বেইজড ইনকোয়ারি অ্যাসোসিয়েটসের। যেখানে এসবের বিস্তারিত পাওয়া যাবে।
নিজস্ব ওয়েবসাইটে বিবিসির পল মায়ার্স’ও অনলাইন রিসার্চের সব কৌশলই তুলে রেখেছেন। এরপরও তার দুই ঘণ্টার সেশনে আগ্রহের কমতি ছিল না সম্মেলনে অংশগ্রহনকারীদের। যেখানে তারা জেনেছেন, কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির বন্ধুকে অনুসরণ করে অনুসন্ধানের পদ্ধতিও। ভীড় ছিল, মোবাইল জার্নালিজমের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ইভো বুরামের হাতে-কলমে মোজো শেখানোর সেশনগুলোতেও। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে, তথ্য যাচাই আর অনুসন্ধানের ভুল এড়ানোর পদ্ধতি শেখানোর সেশনের দরজায়তো রীতিমত হাউজফুলের নোটিশ টানাতে হয়েছে স্বেচ্ছাসেবীদের।
নিত্য নতুন এসব টুলস, প্রযুক্তি আর কৌশলই যে আগামী দিনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে বদলে দেবে, সে কথাতো সম্মেলনের প্রথম দিনেই বলছিলেন অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট ওসিসিআরপির সম্পাদক ড্রিউ সুলিভান। তার ভাষায়, ‘আগামী ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে আমরা এমন কিছু পরিবর্তন দেখতে পাবো, যা আগামী ২০ বছরের বৈশ্বিক সাংবাদিকতাকে বদলে দেবে।’দুনিয়া বদলে দেয়া এসব প্রযুক্তি আর কৌশলের অনেক কিছুই হয়তো এখন ঘরে বসেই শেখা সম্ভব, অনলাইন কোর্স, ওয়েবনার আর ইউটিউবে। তাই এর বাইরে একাদশ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের বড় প্রাপ্তি হয়ে রইলো, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সাংবাদিক আর তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি। সেখানে স্বৈরশাসকের অধীনে উগান্ডা বা বতসোয়ানায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রতিদিনকার চ্যালেঞ্জ যেমন ছিলো, তেমন ছিলো রাশিয়ায় অনুসন্ধান করতে গিয়ে সিক্রেট সার্ভিসের হাতে নিহত সাংবাদিকের কথাও।
জানা গেলো, গণমাধ্যমে অনিয়মিত বেতন কেবল একটি দেশের উদাহারণ নয়, এটি এখন সাংবাদিকতাকে চাপে রাখার বৈশ্বিক প্রবণতা। দুপুরের খাবার খেতে খেতেই, দ্য হিন্দুর উপ সম্পাদকের কাছ থেকে পরামর্শ পাওয়া গেলো, অর্থনৈতিক সাংবাদিকতায় উচ্চ শিক্ষার সব সুযোগের। ডেভিড কাপলান আর তার ব্যান্ড মাকর্যাকার্সের কনসার্ট দেখতে দেখতে, হাত বাড়িয়ে অনুসন্ধানে সহায়তার আগ্রহ জানালেন জর্ডানের আরব রিপোর্টার্স ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের ইয়াজাব রুস।
সেই সাথে কয়েক দফা পুলিৎজার বিজয়ী কিংবা টাইম ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত সম্পাদকদের সঙ্গে একটি ছবি বা লনে দাড়িয়ে পাঁচ মিনিটের আলাপচারিতাই বা কম কী তরুণ সাংবাদিকের জন্যে। সেই কথোপকথনে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা আর চ্যালেঞ্জ নিয়েও আগ্রহের কমতি ছিলো না কারো। তাইতো, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের সেশনে শ’খানেক সাংবাদিককে মেঝেতে বসেই বক্তৃতা শুনতে হয়েছে।
বিরূপ পরিবেশে সাংবাদিকতা নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন মারিয়া রেসা’ও। রেসা ফিলিপাইনের গণমাধ্যম র্যাপলারের সম্পাদক। যিনি ফিলিপাইন সরকারের মাদক বিরোধী রক্তাক্ত অভিযান নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে কর্তৃত্বপরায়ণ প্রেসিডেন্টের রোষানলে পড়েছেন। আদালত থেকে জামিন নিয়ে যোগ দিতে হয়েছে এই সম্মেলনে।
সেই সম্মেলনের শেষ দিনে, হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে স্মারক বক্তৃতায় তিনি বললেন, ‘আমরা এখন একটি অস্তিত্ব সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ। যার শেষ ধাপটি হলো আমাদের ভয় দেখানো আর হয়রানি করা। কারণ আমাদের পেশা সাংবাদিকতা। সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ মানে, সত্যের ওপর আক্রমণ, গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ।’
সেই আক্রমণ ঠেকাতে জোটবদ্ধ অনুসন্ধানের তাগিদ এলো বৈশ্বিক এই সম্মেলন থেকে। সাংবাদিকতা অপরাধ নয়- এমন ব্যানার তুলে জানান দেয়া হলো, সাংবাদিক তিনি যে দেশেরই হন, তিনি একা নন। ‘কেননা একজনের উপর হামলা মানে, আমাদের সবার উপর হামলা।’ এমন সংহতি বোধই, বড় শক্তি হয়ে আলো ছড়াবে বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায়। আশা, কিছু আলোকচ্ছটা পড়বে বাংলাদেশেও।