চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

যে দৃশ্য কেউ দেখেনি আগে

পুলিশ প্রটোকলে মন্ত্রীর গাড়ি। সাদা গাড়ির ভেতরে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা থামিয়ে দিলো। তারা জানতে পারলো খোদ মন্ত্রীর গাড়ির চালকেরই লাইসেন্স নেই, অথবা লাইসেন্স সঙ্গে নেই। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে মন্ত্রী মহোদয় সাদা গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। পেছনে থাকা কালো রঙের আরেকটি গাড়িতে উঠে রওনা হলেন। তিনি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। পানিসম্পদ মন্ত্রী। একসময়ের যোগাযোগ মন্ত্রী। আশি-নব্বই দশকে দেশের সড়ক ও সেতু ব্যবস্থার যে উন্নয়ন, তার একটা বড় অংশই হয়েছে তার হাত ধরে। কিন্তু এই সিনিয়র রাজনীতিবিদকেই আজ তার সন্তান বা নাতি-নাতনির বয়সীদের দাবির মুখে, সড়কে নিয়ম প্রতিষ্ঠার দাবিতে গাড়ি থেকে নেমে যেতে হলো। তিনি যখন নামছিলেন তখন শিক্ষার্থীদের ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারিপাশ।

এর ঠিক আগের দিন একইরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন দেশের ছাত্র রাজনীতির প্রাণপুরুষ, উনসত্তুরের গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক, শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া তোফায়েল আহমেদ। যিনি এখন বাণিজ্যমন্ত্রী। উল্টো পথে যাচ্ছিলেন তিনি। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আটকে দেয় তাকে। শিক্ষার্থীরা তাকে যেভাবে সম্মান করে এবং যে ভাষায় তার ভুল ধরিয়ে দিয়ে যুক্তিপূর্ণ অনুরোধে গাড়িটি যে পথে এসেছে সেই পথে যেতে বাধ্য করলো, সেই দৃশ্য অভূতপূর্ব। যদিও তোফায়েল আহমেদ গাড়ি থেকে নেমে শিক্ষার্থীদের বলেছেন, তিনি তাদের সাথে কথা বলার জন্য উল্টো পথে এসেছেন।

স্বাধীনতার ৪৭ পরে ২০১৮ সালে এসে দুরন্ত আঠারোর এই এক অদ্ভুত জাগরণ দেখছে দেশবাসী। এমন সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে বা ঘটেছে যা এক সপ্তাহ আগে কারো কল্পনায়ও ছিল না।

পুলিশ তার নিজের গাড়ির বিরুদ্ধে নিজেই মামলা দিচ্ছে। সরকারের নানা প্রতিষ্ঠান তো বটেই, খোদ গণমাধ্যমের গাড়িও তারা আটকে দিচ্ছে এবং গাড়ির ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স না থাকলে সেই গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দিতে বাধ্য করছে। কিছু গাড়ি ভাংচুরও করা হয়েছে।

যারা এই কাজগুলো করছে, তাদের বয়স ১৬ থেকে ২০/২২ এর মধ্যে। অর্থাৎ স্কুলের শেষ এবং কলেজে পড়ুয়া, বড়জোর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী; উঠতি তারুণ্য যাকে বলে।

এই প্রজন্মের ব্যাপারে এতদিন সমাজের কথিত সচেতন মহলের বেশ হতাশাব্যঞ্জক আর নেতিবাচক ধারণা ছিল যেমন, ‘এখনকার পোলাপান সারাদিন ফেসবুক নিয়া থাকে, দিন-দুনিয়ার কোনো খবর রাখে না, তারা সেলফিস, তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের ভালো-মন্দে একাত্ম হয় না, তারা বার্গার খায়, তারা এই করে সেই করে, তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নাই’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু সবাইকে বিস্মিত এবং বিহ্বল করে দিয়ে সেই প্রজন্মই রাস্তায় নেমে এলো ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে। তারা কীসের জাস্টিস বা ন্যায়বিচার চায়? তারা সরকারের পতন চায় না। তারা উন্নয়ন নাকি গণতন্ত্র সেই তর্কে যায় না। তাদের দাবি খুব পরিস্কার। আর তা হলো, সড়কে শৃঙ্খলা। বছরের পর বছর দেশের সড়ক ব্যবস্থায় যে নৈরাজ্য, যে বিশৃঙ্খলা, যে মাফিয়ার দৌরাত্ম্য, যে মৃত্যুর মহামারি, যে অনিয়ম, যে বেপরোয়া আচরণ- তারা এসব থেকে মুক্তি চায়।

বিস্ময়করভাবে দেখা গেলো, এই শিশু-কিশোরদের সঙ্গে তাদের অনেক অভিভাবকও রাস্তায় নেমেছেন। বলেছেন, তারাও এই দাবিতে একমত। কারণ তাদের পাবলিক পরিবহনে চলতে হয়। কিন্তু দিনের পর দিন তাদের সঙ্গে যে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে, তাদেরকে জিম্মি করে যেভাবে পয়সা আদায় করেছে পরিবহন মালিকরা, কিন্তু বিনিময়ে কোনো সেবা তো দূরে থাক, উল্টো ফুটপাথে গাড়ি উঠিয়ে দিয়ে নিরীহ মানুষের প্রাণ নিয়েছে-সেই বিভীষিকার অবসান তারা চান। ফলে সন্তানের সাথে অভিভাবকও এখন বলছেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।

তো সেই জাস্টিস কে নিশ্চিত করবে? করবেন রাষ্ট্রের কর্তারা। কিন্তু দেখা দেখা গেলো, কর্তারাই উল্টোপথে গাড়ি চালান। কর্তাদের গাড়ির চালকেরই লাইসেন্স নেই। যে আইশৃঙ্খলা বাহিনী রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগ করবে, আইনের শাসন নিশ্চিত করবে, তাদের গাড়িরই ফিটনেস নেই, তাদের গাড়ির চালকের লাইসেন্স নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা সেইসব গাড়ি থামিয়ে পুলিশকেই বাধ্য করছে মামলা দিতে এবং গাড়ির গায়ে তারা কালি দিয়ে লিখে দিচ্ছে, ‘লাইসেন্স নাই’।

কী বার্তা দিচ্ছে এই তারুণ্য? গল্পটা সেই রাজার নতুন পোশাকের মতো? একজন রাজা নতুন পোশাক পরে বেরিয়েছেন। এমন পোশাক, যে পোশাকে এর আগে কেউ রাজাকে দেখেনি। সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখছে আর ভাবছে আহা রাজার এ কেমন পোশাক। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। কারণ রাজার পোশাকের সত্যিকারের মাহাত্ম্য যারা বুঝবে না, তারা নিজেদের পদে থাকার অযোগ্য-এমন ঘোষণা আগেই ছিল। ফলে রাজার পোশাক দেখে সবাই বিস্মিত হয় কিন্তু নিরব থাকে। অগত্যা ন্যাংটো শিশুরা চিৎকার করে ওঠে, ওই দেখো রাজা আমাদের মতো পোশাক পরেছে। মানে রাজার কোনো পোশাকই নেই। রাজা উলঙ্গ।

যে শিশু-কিশোররা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে রাস্তায় নেমে এলো, স্কুলের পোশাক পরে, বৃষ্টিতে ভিজে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স আর গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট চেক করছে, তারা মূলত চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, কোনো কিছুই ঠিকভাবে চলছে না। যে কথা এতদিন কেউ বলেনি, তা এই শিশুরা চিৎকার করে বলছে। তারা বলছে, ওই দেখো রাজার পোশাক নেই।

শিশু-কিশোররা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, কেউই তার কাজটা সঠিকভাবে করছে না। যে পুলিশ গাড়ির ফিটনেস আর ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করবে, তাদেরই লাইসেন্স নেই। যে গণমাধ্যম সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরবে, তাদের গাড়িই নিয়ম মেনে চলে না। যে মন্ত্রীরা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ করেন, তারাই উল্টো পথে চলেন। তাদের চালকেরই লাইসেন্স নেই। ফলে তারা জাস্টিস চায়। ফলে তারা লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের গাড়ির চালকের বিরুদ্ধেও মামলা দিতে বাধ্য করে। এই দৃশ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এর আগে কেউ দেখেনি। এ এক অদ্ভুত বাস্তবতা; ভুক্তভোগীদের জন্য এ এক করুণ অভিজ্ঞতা। যারা বছরের পর বছর মনে করে আসছিলেন তারা সব নিয়ম কানুন আর আইনের ঊর্ধ্বে, তারা নাজেহাল হচ্ছেন এমন একটি প্রজেন্মর হাতে, যারা ভোটের হিসাবে তো বটেই, অন্য কোনোভাবেই কারো গণনার ভেতরে ছিলেন না। যাদেরকে বার্গার বা ডিজুস জেনারেশন বলেই এতদিন টিপ্পনি কাটা হয়েছে। সেই প্রজন্ম রাস্তায় নেমেছে ন্যায়বিচারের দাবিতে।

আখেরে এই ঘটনায় সড়কে শৃঙ্খলা কতটুকু ফিরবে বা সড়কে নৈরাজ্য কতটুকু থাকবে তা এখনই বলা মুশকিল। কিন্তু অর্ধশত বছর ধরে এই দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় যে অন্যায়, যে অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলা চলে আসছে, যে রকম মাফিয়ার দৌরাত্ম্য চলে আসছে-তার বিরুদ্ধে কারো না কারো রুখে দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিল বটে। কিন্তু যে কাজটি করার কথা ছিল বড়দের-সেই বড় কাজটি করে দেখালো ছোটরা। তাদের অভিবাদন। তবে সতর্ক থাকা দরকার, যাতে কোনো সুযোগসন্ধানী পক্ষ তাদের নিজেদের স্বার্থে এই প্রজন্মকে ব্যবহার করতে না পারে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)