চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

যে গল্পের নতুন শিরোনাম জাহানারা

ছেলেদের আইপিএলের মাঝেই হয়ে গেল মেয়েদের আইপিএলের দারুণ এক প্রদর্শনী। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের লক্ষ্য ছিল তিন দলের ছোট্ট পরিসরের আয়োজন কেমন সাড়া ফেলে পরখ করা। টুর্নামেন্ট শেষে তাদের প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা! তুমুল উত্তেজনার পর শেষ বলে নির্ধারিত হয়েছে শিরোপা ভাগ্য। পাঁচ দেশের ক্রিকেটারের সম্মিলন ঘটায় টিভি পর্দায় চোখ রাখা দর্শকসংখ্যাও ছিল অগনিত।

কাকতালীয়ভাবে পরেরদিন ছেলেদের ফাইনালও নিষ্পত্তি হয়েছে শেষ বলের রোমাঞ্চে। আরেকটি বড় অনুষঙ্গ হল, মেয়েদের ফাইনালে বাংলাদেশের পেসার জাহানারা আলমের একটি ডেলিভারি ভাইরাল হয়ে প্রশংসার ঝড় তুলেছে নেট দুনিয়ায়। টুর্নামেন্টের সেরা তো বটেই, নারী ক্রিকেটের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ডেলিভারি কিনা হচ্ছে এমন আলোচনাও।

জাহানারার ছোঁড়া বলটি ঘিরে বাড়তি এই আলোচনা সদ্যগত টুর্নামেন্টকে নিয়ে গেছে সাফল্যের মানদণ্ডে আরও কয়েকধাপ উপরের সারিতে। দাবি উঠেছে ছেলেদের আইপিএলের আদলে বড় কলেবরে মেয়েদের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আয়োজনেরও।

‘উইমেন্স টি-টুয়েন্টি চ্যালেঞ্জ’ প্রত্যাশিত সাড়া পেলে ভবিষ্যতে রূপ নেবে উইমেন্স ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে। সেই শর্তে যেন বড় ‘বিজ্ঞাপন’ই হয়ে উঠল টাইগ্রেস পেসার জাহানারার বিস্ময় জাগানিয়া দুটি ডেলিভারি।

শনিবার রাতের ফাইনালে জাহানারা জয়পুরে ভেলোসিটির হয়ে সুপারনোভাসের দুই বিদেশি ব্যাটারের স্টাম্প উপরে ফেলেন রিভার্স সুইংয়ের জাদুতে। হাওয়ার ওপর বল ইন-কাট করে ভেতরে আসছে, আবার তা মাটিতে পড়ার পর দিক বদলে বেরিয়ে যাচ্ছে আউট সুইং হয়ে, মেয়েদের ক্রিকেটে যেটি বিরল দৃশ্যই!

জাহানারা ৪ ওভারে ২১ রানে দুই উইকেট নিলেও ভেলোসিটি শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি। তবে কিউই ব্যাটার নাটালি শিভারকে করা তার বোল্ড আউটটি (ম্যাচে নিজের দ্বিতীয় শিকার) ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। টুর্নামেন্টের সেরা ডেলিভারির তকমা পেয়ে গেছে। সেই আলোচনার উত্তাপেই চড়ে ওঠা পারদ স্বল্প পরিসরের আসরকে অন্যমাত্রা দিয়ে দৃষ্টি সীমানায় যোগান দিচ্ছে বড় পরিসরে আয়োজনের চিন্তা। মেয়েদের আইপিএলের নতুন গল্পে শিরোনাম কিংবা ভূমিকায় তাই জাহানারা থাকছেনই।

ভারত মাতিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা ও প্রাণঢালা অভিনন্দন বার্তায় সিক্ত হচ্ছেন ২৬ বছর বয়সী এ পেসার। যা আগামীতে জাহানারার জন্য রসদ হিসেবে কাজ করবে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বড় মঞ্চে নিজেকে সফল করতে।

দুটি উইকেট ছাড়া ভারত থেকে আর কি নিয়ে ফিরলেন? উত্তরে জাহানারা যেটি বোঝাতে চাইলেন তা হল- অনুপ্রেরণা আর নতুন সব ইতিবাচক উপলব্ধি, ‘সব থেকে বড় যেটি নিয়ে এসেছি, সেটি অনুপ্রেরণা। যা সত্যিই গভীরভাবে অনুভব করতে পারছি। এমনিতে কিন্তু আমরা বড় মঞ্চ বলতে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে পারফর্ম করি। প্রতিযোগিতা করি। সেখানে থাকে একটি দলের সঙ্গে খেলা। আর এখানে চারজন বিদেশি ক্রিকেটার এবং ভারতের ক্রিকেটার। পাঁচটা দেশের খেলোয়াড় একতাবদ্ধ হয়ে খেলার যে মনোভাবটা, সেটা অন্যরকম শেখার একটা বিষয়।’

‘আমরা সবসময় মনে করি বাংলাদেশ উইমেন্স টিমের ক্রিকেটার, আমাদের কী কী করতে হবে? বিশ্বকাপের জন্য আগে বাছাইপর্ব খেলতে হবে। তার জন্য যা করতে হবে, ফিটনেস টেস্টে টিকে থাকতে হবে। কিছু কাজ করে বেঞ্চমার্ক স্পর্শ করতে হবে। এটুকু করলেই হবে বা আমাদের যারা প্রতিযোগী আছে তাদের টপকে সেরা একাদশে থেকে পারফর্ম করতে হবে দেশের জন্য।’

‘কিন্তু যদি এই জায়গায় খেলেন, মেয়েদের আইপিএলের মতো জায়গায় চিন্তা করেন, তাহলে ছোট চিন্তা করলে হবে না। আরেকটু বড় চিন্তা করতে হবে। বড় মঞ্চে পারফর্ম করতে হলে অনেক কষ্ট করতে হবে। সেরাদের সঙ্গে লড়াই করতে হলে তাদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হবে। সে কষ্ট করার অনুপ্রেরণা নিয়ে এসেছি। আমার বিশ্বাস সামনের যে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব, বিশ্বকাপ, পরবর্তী আইপিএল, জানি না দল পাব কিনা, কিন্তু এসবের জন্য নিজেকে অন্যভাবে তৈরি করার অনুপ্রেরণা আমি পেয়েছি।’ চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে আলাপচারিতায় অনুভূতিগুলো এভাবেই জানালেন জাহানারা।

যেভাবে হয়ে গেল রিভার্স সুইং
আসলে এতটা প্রত্যাশা করিনি যে, টি-টুয়েন্টিতে বল একটু পুরাতন হতেই আমি রিভার্স সুইং পেয়ে যাব। আমি সিমে বল হিট করেছি আউটসুইংয়ের আশায়। প্রথমে বল যখন ইনসুইং হয়েও ওয়াইড হল, দেখবেন তিন-চারটা ওয়াইড দিয়ে ফেলেছি, নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারিনি। এত পরিমাণ রিভার্স পাচ্ছিলাম। তখন চেষ্টা করলাম যে বাইরে থেকে যদি ভেতরে ঢোকাই তাহলে ডট হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। ওরাও মারার সুযোগ খুঁজছিল। যেহেতু দুটি ডেলিভারিই ভালো ছিল, দ্বিতীয় বলটা যেহেতু বেশি ভালো হয়েছে, ‘বল অব দ্য টুর্নামেন্ট’ হয়েছে। বড় পাওয়া বলতে পারেন। পেস বোলার হিসেবে এটা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।

ছবির মতোই পারফরম্যান্সেও উড়ন্ত ছিলেন জাহানারা

‘পেশাদারিত্ব কাকে বলে বুঝেছি’
আমাদের দলের শিখা পাণ্ডের সঙ্গে কথা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ও ভারতের অলরাউন্ডার। অনেক ভালো একজন মানুষ। ভালো ক্রিকেটার। বেশ বুদ্ধিমতী। তার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে। এখানে যারা ছিল তাদের মধ্যে নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের ওরা খুব বেশি পেশাদার। এমনিতে আমরাও দাবি করি নিজেদের পেশাদার হিসেবে। কিন্তু ক্রিকেটকে পেশাদার হিসেবে নেয়ার জন্য যা প্রয়োজন আমরা তা থেকে অনেক দূরে। ধরাছোঁয়ার বাইরেই আছি।

নিজেদের আরও তৈরি করে প্রতিযোগিতায় যেতে হবে, আমি যেমন আছি তা যথেষ্ট না। বললেই হবে না বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে থাকব, আইপিএল খেলব। এটা সহজ না। এর জন্য নিজেকে আগে থেকেই প্রস্তুত রাখতে হবে এবং ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করতে হবে। এই জিনিসটা শিখতে হবে। এটা বুঝেছি যে শতভাগ মনোযোগ দিয়ে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করতে হবে। কিন্তু এটার জন্য তো প্রস্তুতি দরকার, যেটা করতে হবে।

বিসিবি সভাপতির অভিনন্দন বার্তা
দ্বিতীয় ম্যাচে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম, খুব বেশি ভালো করতে পারিনি। লক্ষ্য ছিল সুযোগ পেলে যত কম ইকোনমি রাখা যায়। আমার সবসময়ই চোখ থাকে ডট বলের প্রতি। তিন ওভার সফল হলেও শেষ ওভারটা তেমন হয়ে ওঠেনি। কারণ যারা তখন ক্রিজে ছিল হারমানপ্রীত সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন, কঠিন ছিল তার বিপরীতে ওভাবে বোলিং করা। বিশ্বের সেরা দুই ব্যাটারের উইকেট নিতে পারা এবং টুর্নামেন্টের সেরা বলটি করা আমার কাছে বড় প্রাপ্তি।

তার সঙ্গে সবার শুভেচ্ছা, বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষী, পরিবার, ভক্ত, ক্রিকেট বোর্ডের অনেক মানুষ। সব থেকে বড় যেটা বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন স্যার ম্যাচের সময়ই হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আমার মনে হয় এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর হতে পারে না। সবাই খেলা দেখেছেন, খেয়াল করেছেন, সমর্থন করেছেন, দেয়া করেছেন। শেষ ম্যাচে হলেও আমি সেটার মূল্যায়ন করতে পেরেছি। তা-ই আমার কাছে বড় পাওয়া।

দুই ম্যাচের পারিশ্রমিক ৬ লাখ
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের পুরো মৌসুম খেলে জাহানারা যা পাবেন তার চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাচ্ছেন ওই দুই ম্যাচ খেলেই। প্রথম ম্যাচে একাদশে সুযোগ পাননি। খেলেছেন পরের দুই ম্যাচ। তবে জাহানারা পাবেন তিন ম্যাচের টাকাই। ম্যাচপ্রতি আড়াই হাজার ইউএস ডলার করে দেয়ার কথা বিদেশি ক্রিকেটারদের। তাতে পাবেন সাড়ে সাত হাজার ডলার, টাকার অঙ্কে যেটি ৬ লাখ ৩২ হাজার। এক মৌসুমে ঘরোয়া ক্রিকেট খেললে যা আয় হয় সেটি জাহানারা পেতে যাচ্ছেন মাত্র এক সপ্তাহেই।

ভেলোসিটির সঙ্গে আর্থিক চুক্তি বিষয়ে জাহানারা বলেন, ‘এটা ছিল মেয়েদের আইপিএলের প্রদর্শনী টুর্নামেন্ট। এটা যদি ব্যাপক সাড়া পায় তাহলে পরের বছর হয়ত ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ হবে। বলতে পারেন ওই ধরণের আসরই এটি। তিন দলে ১২ জন বিদেশি খেলোয়াড় ছিল, ম্যাচপ্রতি সবাইকে আড়াই হাজার ইউএস ডলার করে দেবে। কাউকে কমও না, বেশিও না। সমান হারে দেবে। আমি দুই ম্যাচ খেলেছি, কিন্তু তিন ম্যাচের পারিশ্রমিক পাওয়ার কথা। কেননা তারাই আমাকে বসিয়ে রেখেছে। টাকা অ্যাকাউন্টে আসলে বুঝতে পারব।’