যারা ড্রিবলিং পারে না তারাই নাকি ডিফেন্ডার! একটা সময় পর্যন্ত এমন কথা বেশ জোরেশোরেই প্রচলিত ছিল ব্রাজিলিয়ান রক্ষণসেনাদের সম্পর্কে। জোগো বনিতার দেশে অপরূপ পায়ের কাজ, দুর্দান্ত স্কিল আর অসাধারণ গোলই যেখানে শেষ কথা; সেখানে তারকারদের পেছনে দাঁড়িয়ে দূর্গ সামলানো সেনাদের কথা কেইবা মনে রাখে!
আশার কথা হচ্ছে, ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডারদের দুঃখ-অপবাদের দিন সম্ভবত শেষ হতে চলেছে! টিটে নামের ৫৭ বছর বয়সী এক ফুটবল দার্শনিক দেখিয়ে দিচ্ছেন, শিরোপা কেবল আক্রমণে ভর করে আসে না, চাই জমাট রক্ষণও। নেইমারের মতো অসাধারণ এক কৌশলি ফুটবলার থাকার পরও টিটে তার রক্ষণ ভারি করেছেন একদল নিবেদিত, পরিশ্রমী, সাফল্যে বিশ্বাসী ডিফেন্ডারদের দিয়ে। ফলটা দেখুন; দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত সেলেসাওদের জালে বল জড়িয়েছে কেবল মাত্র একবার!
টিটে কখনোই ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে খেলেননি। বড় বড় কোচদের মতো তার জীবনবৃত্তান্ত ভারিও নয়। তবে, তার মন ভীষণ রকমের কৌতূহলি। ২০০৮-০৯ মৌসুমে যখন ইন্টারন্যাসিওনালের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন, তখন তার অধীনে খেলেছেন আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার আন্দ্রেস ডি আলেহান্দ্রো। আলেহান্দ্রোই তাকে ইউরোপিয়ান ফুটবল সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। ইউরোপিয়ান ফুটবলে কতটা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয় সেটা সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছিলেন।
সেই জ্ঞান বাড়াতে ইউরোপ সফরে যান টিটে। পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনা, কার্লো আনচেলত্তির রিয়াল মাদ্রিদ ও আর্সেন ওয়েঙ্গারের আর্সেনালের কোচিং দর্শন মগজে নিয়ে ফেরেন। পরে সেটা কাজে লাগান করিন্থিয়াসে। ফলাফল, ২০১১-১২ মৌসুমে ঘরোয়া ও সাউথ আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব জিতে নেয় ব্রাজিলিয়ান ক্লাবটি। চেলসির মতো জায়ান্ট ক্লাবকে হারিয়ে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের ট্রফিও করিন্থিয়াসের শোকেসে জমা হয় সেবারই।
কিন্তু টিটের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা ছিল ২০১৪ বিশ্বকাপের মিনেইরো ম্যাচ থেকে। জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার ম্যাচটি টিভিতে দেখেছিলেন এই কোচ। চোখে পানি থাকলেও তখনই তার মাথায় আসে ম্যাচ জিততে এই ব্রাজিলের কেবল আক্রমণ নয়, দরকার প্রতিপক্ষকে কাঁপিয়ে দেয়া একস্তম্ভ রক্ষণেরও। টিটে অবশ্য তখনও জানতেন না দুই বছর বাদে সেই ব্রাজিলকেই সামলানোর দায়িত্ব চাপবে কাঁধে।
২০১৬ সালে যখন দায়িত্ব পেলেন টিটে, ব্রাজিল দলে তখনও মিনেইরোর কালো ছায়া। অনেকের বিশ্বাস ছিল বিশ্বকাপে গেলেও দ্রুতই ঝরে যাবে দলটি।
টিটে তা হতে দিলেন কই! এসেই কোমর বেঁধে নামলেন নেইমারদের আত্মবিশ্বাস ফেরাতে। সঙ্গে করিন্থিয়াসে প্রয়োগ করা কৌশল কাজে লাগালেন জাতীয় দলে। ৩-৫-২ কৌশলে খেলা করিন্থিয়াস সমালোচিত ছিল ন্যুনতম গোলে জয়ের জন্য। সে কৌশলে পরিবর্তন আসল। টিটে নতুন কৌশলের সঙ্গে ইউরোপের নমনীয়তা, শক্তি আর চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা যোগ করলেন। সঙ্গে আনলেন করিন্থিয়াসের ফাগনারকে। দানি আলভেজের পরিবর্তে এই রাইটব্যাক কতটা উজ্জ্বল সেটাতো রাশিয়া বিশ্বকাপেই প্রমাণিত।
রাশিয়ায় টিটের কৌশলে মূল জায়গা তিনটি- একজন হোল্ডিং মিডফিল্ডার, একজন প্লে-মেকার এবং একজন বক্স-টু-বক্স রেইডার। এই তিন পজিশন দখলে রেখে ব্রাজিল দল চোখের পলকে পরিবর্তন করতে পারে তাদের ফর্মেশন। নেইমারের উপর তাতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে না। আক্রমণভাগকে খুব একটা নিচে নেমে আসতে হয় না। প্রতিপক্ষ তেমন জায়গাও পায় না কাউন্টার অ্যাটাকের।
শেষ ষোলোতে মেক্সিকোর বিপক্ষেই দেখা গেছে নিজেদের রক্ষণ ছেড়ে মোটেও উপরে চলে আসেননি সেলেসাও ডিফেন্ডাররা। ফলে জার্মানির বিপক্ষে যেভাবে কাউন্টার অ্যাটাকে খেলেছে মেক্সিকানরা, ব্রাজিলের বিপক্ষে সুবিধা করতে পারেনি মোটেও।
ফাগনার কেবল রাইটব্যাকই নন। মেক্সিকো ম্যাচে মার্সেলো না থাকায় সমানতালে সামলেছেন লেফটব্যাকের দায়িত্বও। হোল্ডার ছিলেন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ডিফেন্ডার ফিলিপে লুইস। ব্রাজিল মূল একাদশে নিয়মিত সুযোগ পান না, কিন্তু লুইস দেখিয়ে দিয়েছেন নিজের দায়িত্বে কতটা নিবেদিত তিনি।
একইভাবে মিরান্ডাও নিজেকে প্রমাণ করেছেন ব্রাজিলিয়ান রক্ষণের মেরুদন্ড হিসেবে। আর থিয়াগো সিলভা আছেন তার মতই, যিনি প্রতিপক্ষকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নন কোনো পরিস্থিতিতেই।
ডিফেন্ডারদের দায়িত্বশীল খেলায় এখন আর রক্ষণ নিয়ে ভাবতে হয় না নেইমার-কৌতিনহোদের। তারা তাদের খেলা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে পারেন। নিচে খুব একটা নেমে আসতে হয় না আক্রমণ ভাগের খেলোয়াড়দের।
দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই রক্ষণ গোছাতে চেয়েছিলেন টিটে। সেই রক্ষণ যেভাবে গুছিয়েছেন, তা থেকে শিক্ষা নিলে কাজটা সহজ হতে পারে ব্রাজিলের প্রতিবেশি আর্জেন্টিনার জন্যও। কেবল মেসি-আগুয়েরোদের উপর নির্ভর করে বিশ্বকাপ জিততে আসা কতটা শিশুসুলভ তা হয়ত উপলব্ধি করতে পারবে আলবিসেলেস্তারা।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কিংবদন্তি কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন তো আর সাধে সাধে বলেননি, ‘আক্রমণ আপনাকে ম্যাচ জেতাবে, আর রক্ষণ জেতাবে শিরোপা।’