দুটো বিশ্বযুদ্ধ, পৃথিবীর নবনব রাষ্ট্রের বিকাশ, কলোনির পতন, কলোনির স্থলে নতুন চেহারায় সাম্রাজ্যবাদের উপস্থিতি, জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিনতি। যন্ত্রের সর্বোচ্চ উৎকর্ষতা। সমাজতান্ত্রিক এপ্রোচ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান-পতনসহ বহু অভিনব ঘটনার জন্য পৃথিবীর সূচনা লগ্ন থেকে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য শতক, তর্কাতীত বিংশ শতক। এই শতকের অন্যতম একটি ফেনোমেনা চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান পুরুষ চার্লি চ্যাপলিন।
এই শতকের যন্ত্র-উৎকর্ষতার সাথে আগত নতুন ও সর্বশেষ শিল্প মাধ্যমে নিজের প্রতিভার সবটা ঢেলে দেন চার্লি চ্যাপলিন। কৌতুককে অস্ত্র করে তিনি স্পর্শ করেন মানুষের সবচেয়ে আলোকিত স্থান থেকে সবচে অন্ধকার স্থান সমূহে, ঘূর্ণাবর্তে। হাসির হল্কার ভেতর থেকে হঠাৎ তিনি বের করে আনেন গুঢ় বাস্তবতা। কোন শ্যালো কৌতুককে তিনি হঠাৎ টার্ন করাচ্ছেন গভীর বোধে, যে হাসিতে ফেটে পড়ছিল সেই ডুকরে উঠছে এক মুহূর্তে!
চার্লি চ্যাপলিনের প্রধান কাজের সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাপর। শিল্প ও শিল্পী কোন না কোনভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন সময়কে। চার্লি ও তার চলচ্চিত্রও তার বিশেষ ব্যতিক্রম নয়। তিনিও তাঁর সময়ের হাসি কান্না, অবক্ষয় উন্নতি, প্রতিক্রিয়া প্রগতি, মহত্ত্ব নীচতা, অভাব প্রাচুর্য, প্ররোচনা, প্রতারণা, বিশ্বস্ততা, গতি আর স্থবিরতা, রাজনীতি আর প্রতিরাজনীতি সব কিছুই দেখিয়েছেন। আর আশ্রয় নিয়েছেন কৌতুকের।
ফ্রেঞ্চ দার্শনিক হেনরি বারগসন বলছেন, “যে কোন কৌতুকে একজন সম্ভাব্য কবি বাস করেন।”
চার্লি ছিলেন একজন যথার্থ সিনেমার কবি। যিনি তাঁর কবিত্ব সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন চলচ্চিত্রে। তাঁর এই কৌতুককে অস্ত্র হিসেবে নেয়ার অন্য একটি কারণ হয়তো এটিও হতে পারে যে, কৌতুকের রয়েছে একটি নিজস্ব আড়াল–ক্ষমতা। কৌতুকের প্রচুর অর্থ করা যায়। আইনে সহজে আটকে না। আইন না কি নারীর মতোন! আর যে যার মতো করে অর্থ করে নিতে পারে, করতে পারে রসাস্বাদন। যে কোন বয়েস অভিজ্ঞতা প্রজ্ঞা মেধা এই রসাস্বাদনের বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এটাই সম্ভবত তাঁর মহত্ত্বের অন্যতম জায়গা। কিন্তু তাঁর এই কৌতুকপ্রিয়তার ভেতর দিয়ে তিনি বরাবরই তুলে এনেছেন গভীরতম বাস্তবতার বোধ। আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন মানুষের অমানবিকতা, অভাব, বিচ্ছিন্নতা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিষ্ঠুরতা। সেটা জুতা চিবানো কিংবা মেশিনের ভেতর চলে যাওয়া কিংবা খাদ্যযন্ত্রের যন্ত্রণায় পরা যাই হোক না কেন!
তাইতো আইজেনস্টাইনকে আওয়াজ দিতে দেখি, “তাঁর সমস্ত চলচ্চিত্রেই চ্যাপলিনের আরো একজন সঙ্গী রয়েছেন, আরো লম্বা, আরও ভয়ঙ্কর, আরো বলশালী, আরো নির্মম- তার নাম বাস্তবতা!”
ভবঘুরে চ্যাপলিনের এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এই ভবঘুরে প্রাচ্য দেশীয় ধর্মবোধে অনুপ্রাণিত ভবঘুরে থেকে আলাদা। বিশ শতকীয় পচনের কালের, পুঁজির গ্রাসের কালের বিমানবিক একাকী মানুষের কালের এক পাশ্চাত্য ভবঘুরে। যা ঐ সময়ের দারিদ্র্যে ক্লিষ্ট নিপীড়িত মানুষের প্রতিক! যে কিনা হয়ে উঠে এক আন্তর্জাতিক চরিত্র।
ক্ষুধা দারিদ্র্য শ্রীহীনতা মাথায় টুপি বাঁকা লাঠি প্রকাণ্ড জুতা মলিন চাপা কোট আর চরিত্রে কিছুটা শঠতা কৌতুক এবং অগাধ শুভ বোধের দণ্ডে দণ্ডিত এক অনন্য চরিত্র। যে নগণ্য নিপীড়িত তুচ্ছ ক্ষমতাহীন একজন। এই চরিত্রের সর্বশেষ এবং সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র দ্য গ্রেট ডিক্টেটর (১৯৪০)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রচ্ছন্ন বাস্তবতায় এটি নির্মাণ করেন চ্যাপলিন। আর সত্যিকারের শিল্পী যে সময়ের থেকে এগিয়ে থাকেন তার সাক্ষর তিনি রাখেন হিটলারের আদলে গড়া চরিত্রের পরিণতির মধ্য দিয়ে! এই চলচ্চিত্রে ভবঘুরের নাপিত থেকে নৃপতি বনে যাওয়া এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে বদলে যাওয়া মানুষের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে দেয়া ভাষণটি মানুষের শুভ বোধের এক চূড়ান্ত নজির।
এই অশুভের সময়ে শুভবোধ আমাদের অনুপ্রাণিত করুক। মৃত্যু দিনে মহান শিল্পীকে প্রণতি।