চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

যেসব উপায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বদলে কমানো সম্ভব

বিদ্যুত উৎপাদনে সঠিক পরিচালনার মাধ্যমে ব্যয় কমানো গেলে দাম বাড়ানোর বদলে কমানো যাবে বলে মনে করছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব। এই যুক্তি খন্ডন করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তবে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সরকার যদি ভর্তুকির অর্থ পিডিবিকে দেয় এবং আগে দেওয়া ভর্তুকি সুদসহ মওকুফ করে তাহলে দাম বাড়ানোর বদলে কমানো যাবে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার টিসিবির অডিটোরিয়ামে বিদ্যুতের মূল্যহার পরিবর্তন নিয়ে আয়োজিত গণশুনানিতে এ যুক্তি তুলে ধরেন ক্যাবের জ্বালানী বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম। গত ২৫ সেপ্টেম্বর এই গণশুনানি শুরু হয়ে শেষ হয় আজ বৃহস্পতিবার। এই প্রথমবারের মতো বিদ্যুতের দাম কমানোর জন্য গণশুনানির আয়োজন করা হয়।

ভোক্তাদের পক্ষে শুনানিতে অংশ নিয়ে অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন: সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে বেসরকারি কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সরকার যদি সাশ্রয়ী মূল্যে উৎপাদনে প্রাধান্য দিতো, তাহলে ৭ হাজার ৮শ ৪৩ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। আর এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোরও প্রয়োজন হতো না। বরং প্রতি ইউনিটে ১ টাকা ৫৬ পয়সা কমানো সম্ভব হতো।

বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড পিডিবির পাইকারি বিদ্যুতের দাম ৭২ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাবকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক মন্তব্য করে শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুত উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, ভর্তুকির সুদ ২১ পয়সা, পাইকারি বিদ্যুতে মূল্যহার ঘাটতি ৫ পয়সা ও মেঘনা ঘাট আইপিপিতে (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট) ফার্নেস অয়েলের পরিবর্তে ‍ডিজেল ব্যবহারে ঘাটতি ১৪ পয়সা যোগ করা না হলে মোট ব্যয়ভার ৬৬ পয়সা কম হতো।

এছাড়া ভোক্তা পর্যায়ে ১৩২ কেভি লেভেলে বিদ্যুত বিক্রিতে উদ্বৃত আয় ৮ পয়সা এবং পাওয়ার ফ্যাক্টর কারেকশন চার্জ বাবদ আয় ৪ পয়সা মিলে মোট ১২ পয়সা আয়ে যোগ করা হয়নি। এই আয় ব্যয় সমন্বয় করা হলে অর্থাৎ ৬৬ পয়সা খরচ কমানো আর ১২ পয়সা আয় বাড়ানো গেলে (৬৬+১২) মোট ৭৮ পয়সা আয় বৃদ্ধি সম্ভব। কিন্তু পিডিবির প্রস্তাব করেছে ৭২ পয়সা দাম বাড়ানোর। অতএব হিসাব কষে দেখা যাচ্ছে ৭৮ পয়সা থেকে ৭২ পয়সা বাদ দিলে উদ্বৃত থাকে আরো ৬ পয়সা। এর অর্থ এই দাঁড়ায়, সঠিকভাবে খরচ কমানো আর আয় বাড়ানো গেলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোন দরকার নাই।

বিদ্যুত উৎপাদনে অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধি ও আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন: স্বল্প ব্যয়ে বিদ্যুত উৎপাদন করতে হলে কমদামি বিদ্যুত উৎপাদনের কৌশল নিতে হবে। বিদ্যুত উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানীর মূল্যহারে জ্বালানী আমদানির ব্যয় হ্রাস এবং নন-ফুয়েল ব্যয় যৌক্তিক করতে হয়। কিন্তু এ তিনটির কোনটি সঠিকভাবে না করায় উৎপাদনে ব্যয় বাড়ছে ও আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে সরকারের। এই ক্ষতির পরিমাণ ১১ হাজার ৪শ ১১ কোটির টাকারও বেশি। এই ক্ষতির দায়ভার পুরোটাই বহন করতে হয় সাধারণ ভোক্তাকে। যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অবিচার।

তবে ক্যাবের এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেনি বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড। বোর্ডের মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক পরিচালন) কাওসার আমির আলী বলেন: ক্যাবের মন্তব্য হলো উৎপাদন ব্যয় প্রায় ৬ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো-এই মূল্যায়ণটি যথাযথ নয়। এছাড়া ইউনিট প্রতি ১ দশমিক ৩২ টাকা উদ্বৃত থাকার হিসাবটিও বাস্তব সম্মত নয়।

‘তবে বিদ্যুত উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, ভর্তুকির সুদ বাবদ ২১ পয়সা ও ১৩২ কেভি লেভেলে গ্রাহক একক ক্রেতার অধীনে অন্তর্ভুক্ত করলে ৮ পয়সা অর্থাৎ মোট ৫৫ পয়সা সমন্বয় করা হলে এবং ৪ হাজার ৩০০ কোটি ভর্তুকি পাওয়া গেলে হ্রাসকৃত মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।’

এরপর শুনানিতে অংশ নিয়ে বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মুকসুদ বলেন: ভারতে রেলের টিকিটের দাম না বাড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে বরং কমিয়েছে। অতএব বাংলাদেশে ক্যাবের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুতের দাম কমানো উচিত। তবে না কমালে তা হবে জনগণকে বিদ্যুতের শকড দেয়ার মতো।

অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ বলেন: এই মূহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে অন্যসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। ফলে বেড়ে যাবে মুদ্রাস্ফীতি। আর ভারতসহ বিশ্বে জ্বালানী তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে কমেনি। এটিও সমন্বয় করা দরকার।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেকোন কিছুর দাম বৃদ্ধি কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে গণশুনানি করা উচিত। তবে চালের দামের এই উর্দ্ধগতির সময়ে সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনগণের কষ্ট আরও বাড়াবে না বলে আমাদের বিশ্বাস।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন: বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ব্যাংকের ঋণ খেলাপীর অর্থ সমন্বয় করবে। অর্থাৎ ব্যাংকিং খাতে আরও বেশি লুটপাটের সুযোগের ব্যবস্থা করা হবে।

সবশেষে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন: বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে গণশুনানি হলে জবাবদিহিতার বিষয়ে আরও স্বচ্ছতা আসবে। এতদিনের আলোচিত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।