স্বৈরশাসক এরশাদের ৯ বছরের শাসনের অবসান এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের শপথ গ্রহণসহ সব মিলিয়ে ৯০’র ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহটি ছিলো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এক নতুন মাইলফলক।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা তিন রাজনৈতিক জোট যখন ঠিক করতে পারছিলো না কে হবেন নিরপেক্ষ সরকারের রাষ্ট্রপতি, তখন সেই ক্রান্তিকালে সাহাবুদ্দিন আহমেদ সর্বসম্মতভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। তবে তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার ঘটনাটি মোটেও এক বাক্যের ছিলো না।
নব্বইয়ের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ ও একাদশ সংশধোনীর মাধ্যমে পুনরায় প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাওয়া এবং পরে ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আবারো রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করা সাহাবুদ্দিন রাজনীতিক না হয়েও বাংলাদেশের রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক ইতিহাসের এক অন্যতম আলোচিত চরিত্র।
৯০’র ৪ ডিসেম্বর এরশাদ যখন ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দেন তখন বিষয়গুলো খুব কাছ থেকে দেখেছেন ওই সময়ের তরুণ সাংবাদিক বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ফজলুল বারী। চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে তুলে ধরেছেন সেই কঠিন সময়ের কথা।
এরশাদের বিদায়ের দাবিতে তখন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুললেও প্রধান রাজনৈতিক শক্তি ছিলো তিন জোট: ৮ দলীয় জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছিলো আওয়ামী লীগ, ৭ দলীয় জোটের নেতৃত্বে বিএনপি এবং ওয়ার্কার্স-জাসদ (ইনু)সহ ছিলো ৫ দলীয় জোট।
তিন জোটের এরশাদ বিরোধী যুগপৎ আন্দোলন প্রসঙ্গে ফজলুল বারী বলেন: এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনটি জোট মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তবে এই জোট গুলোর নিজেদের মধ্যেও কিছু কিছু সমস্যা ছিলো। বিতর্কও কম ছিলো তাদের মধ্যে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় ও বিএনপি নেতৃত্বধীন ৭ দলীয় জোটের মধ্যে মাঝেমধ্যেই বৈরতা সৃষ্টি হতো। এক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করতেন ইনু-মেননের ৫ দলীয় জোট। ইনু-মেননরা মূলতঃ নেগোশিয়েটরের ভূমিকা পালন করতেন।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ব্যাপকতা পায় ২৭ নভেম্বর টিএসসির কাছে ডা. মিলন নিহত হওয়ার পর। ওই হত্যাকাণ্ডের পর সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সবশেষে ৪ ডিসেম্বর কর্মকর্তা কর্মচারিরাও রাস্তায় নেমে আসলে এরশাদ বিদায় নিতে বাধ্য হন।
কিন্তু এরশাদের বিদায়ে কে নেবেন নির্দলীয় সরকারের দায়িত্ব? এটা ছিলো বিরাট প্রশ্ন।
সব পক্ষ মিলে কারও ব্যাপারেই একমত হতে পারছিলো না। ঠিক সেই সময়ে দৃশ্যপটে আসে ওই সময়ের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহেমেদের নাম।
এ প্রসঙ্গে ফজলুল বারী বলেন, ‘তিনটি রাজনৈতিক জোটই সাহাবুদ্দিন আহমেদের ব্যাপারে একমত হলো। কিন্তু বেঁকে বসলেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ নিজে। তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। কেননা সংবিধান অনুযায়ী একবার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর তার আর প্রধান বিচারপতির আসনে ফিরে আসার সুযোগ ছিলো না।’
‘তাকে রাজি করাতে তিন জোট থেকে তিনজন রাজনৈতিক নেতা ভূমিকা রাখেন। বলা যায় তার দূতিয়ালির ভূমিকা পালন করেন। ৮ দলীয় জোট থেকে গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন, ৭ দলীয় জোট থেকে ছিলেন মেজর জেনারেল (অব). মাজিদ-উল-হক এবং ৫ দলীয় জোটের পক্ষে ভূমিকা রাখেন হাসানুল হক ইনু।’
প্রধান বিচারপতি হিসেবে সাহাবুদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১ জানুয়ারি, ১৯৯০। তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিলো ৩১ জানুয়ারি, ১৯৯৫।
এ প্রসঙ্গ টেনে ফজলুল বারী বলেন, ‘অল্প সময়ের জন্য তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে চাচ্ছিলেন না। কেননা আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য তার প্রধান বিচারপতির আসনে থাকার সুযোগ ছিলো। শেষ পর্যন্ত আবারও প্রধান বিচারপতির আসনে ফিরে আসতে পারবেন এ শর্তে নিরপেক্ষ সরকারের দায়িত্ব নিতে রাজি হন সাহাবুদ্দিন আহমেদ।’
৬ ডিসেম্বর, ১৯৯০ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ৯ অক্টোবর ১৯৯১ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ৯১’র নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার পর খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার সংবিধানে একাদশ সংশোধনী এনে আবারও তাকে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়।
বিচারপতি সাহাবুদ্দিন এভাবে তখন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও স্বভাবত’ই এখনো তাকে মেনে নিতে পারেন না এরশাদ।
বছর তিনেক আগে (১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২) গুলশানে জাতীয় পার্টির এক মতবিনিময় সভায় এরশাদ বলেছিলেন, ‘আমি সুযোগ পেলে সংবিধানের একাদশ সংশোধনী বাতিল করে ‘বেঈমান’ সাহাবুদ্দিনকে বিচারের আওতায় আনবো।’