গ্রামীণ জীবনের নিখাদ সরলতার এক অনবদ্য সৌন্দর্য্য আছে। এমনকী গ্রাম্য পরিবেশে গালিগালাজ, হাতাহাতি, চুলোচুলি, গুজব নিয়ে লোফালুফি এসবের মাঝেও রয়েছে সাহজিক নান্দনিকতা। কিন্তু জীবনে যেহেতু স্পেস এবং টাইম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; তাই মেট্রোপলিটানে ঐ গ্রাম্য সুন্দর বিষয়গুলো খুবই অসুন্দর দেখায়।
ধরা যাক, গ্রামে কোনো কৃষক স্বামী সারাদিন রোদ মাথায় নিয়ে ক্ষেতে কাজ করে এসে খেতে বসে দেখলো খাবার পানি নেই; সে তখন উঠোন থেকে একটা চেলাকাঠ তুলে স্ত্রীকে আঘাত করলে কৃষক বধু ডুকরে কেঁদে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে পাড়া প্রতিবেশী ছুটে আসে। মানবিকতা নিয়েই তারা আসে। অন্ততঃ একজন নারীকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর মানুষ আছে গ্রামে।
অবশ্য কৃষকগৃহের ঘটনাটি মাতবর সাব পর্যন্ত কেউ পৌঁছে দিলে সালিশ বসে। কৃষক বধুর পক্ষে বানিয়ে ছানিয়ে অনেক সাক্ষ্য উপস্থাপিত হয়। কখনো কৃষকের পক্ষে বানিয়ে ছানিয়ে অনেক সাক্ষ্য উপস্থাপিত হয়। এরপর কৃষককে কানধরে উঠবস করানো হয়। অথবা দোষী সাব্যস্ত হলে কৃষক বধুকে তিরস্কার করে মাতবর সাব।
এই সালিশ শেষে বিপুল বিনোদন নিয়ে ফিরে যায় গ্রামবাসী। কেউই চেষ্টা করে না কৃষককে বোঝালো না; যে কোন পরিস্থিতিতে নারীর গায়ে হাত তুলতে নেই। কেউই কৃষক বধূকে বোঝালো না একটা মানুষ এতো খেটে-খুটে রোদ থেকে এলো, তার প্রথম প্রয়োজন একটু পানি। মানে ম্যারেজ কাউন্সেলিং-এর কোনো ধারণা তো বিজনগ্রামে গড়ে ওঠেনি।
ঘরে ঘরে পরচর্চার একটা টাটকা বিষয় পেয়ে যাওয়ায়; গ্রামে আনন্দের একটা উপলক্ষ তৈরি হয়। দুটিপক্ষ হিতৈষী সেজে কৃষক ও তার বধূকে ভাংচি দেয়। এই ভিলেজ পলিটিক্সের প্যাঁচে পড়ে স্বামী-স্ত্রীর কেউ একজন আত্মহত্যা করে বসলে ভাংচি-সমাজ উঠোনে লুটিয়ে পড়ে কাঁদাকাটি করে। থানা-পুলিশ হয়। কয়েকদিন গ্রামবাসী ইনিয়ে বিনিয়ে আত্মহত্যার গল্পটিকে ঘিরে কৃষক ও কৃষকবধূর (যেই আত্মহত্যা করুক না কেনো) চরিত্রহানি করতে থাকে। সেটাও শোকের উৎসব; খিস্তি খেউড়ের যাত্রাপালা। আরেকটি নতুন ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত বিনোদনহীন জীবনে ঐ আত্মহত্যার গল্পটির শাখা প্রশাখা নিয়ত বিনোদন দিতে থাকে।
বিজন গ্রামের সংস্কৃতি এমনই; সেই অন্ধকার থেকে আলোতে বেরিয়ে আসার চেষ্টাতেই গরীব কৃষক রক্ত-পানি করা টাকা খরচ করে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলে। কৃষক বধূ স্বপ্ন দেখে তার মেয়েটি মতো শিক্ষিত হবে। ঘুঁটের ডালি নিয়ে সে ঘুরবে না সারাজীবন।
এই যে শিক্ষিত হয়ে মেট্রোপলিটানে আসা এ হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা। কিন্তু মেট্রোপলিটানে একটি শিক্ষিত দম্পতির জীবনে যদি ও ফেলে আসা গ্রামীণ জীবনের পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং কথিত শিক্ষিত বন্ধু-সহকর্মী সমাজ যদি অবিকল সেই গ্রামের দৃশ্য বিনির্মাণ করে; তখন বুক শেলফের বইগুলো জিভ কাটে লজ্জায়। আধুনিক পোশাক গুলো মুচকি হাসে। এমন কী কফি শপের কফিও বিব্রত হয়।
সংকট গ্রামীণ ও নগর জীবন দুই জায়গাতেই থাকে; সংকট ছাড়া জীবন হয় না। কিন্তু এই সংকটের সমাধানের আঙ্গিক-ভাষারীতি-আচরণবিধিতে পার্থক্য থাকা খুবই জরুরি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)