৯০ দশকের শুরুর কথা। সারা বিকেল দৌড় ঝাঁপ করে সন্ধ্যার পর ঝিমুচ্ছি আর পরের দিনের পড়া তৈরি করছি। পাশের রুমে বিটিভিতে কোনো একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে হয়তো। হঠাৎ অদ্ভুত সুর আর পাশ্চাত্য গায়কিতে কেবল মাত্র একটি লাইনই কানে এলো। ‘তুমি কেন বোঝ না তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়’! মুহূর্তেই উড়ে গেলো শরীরে সব ক্লান্তি। ছুটে গেলাম টিভি রুমে। যতোটা উৎসাহ নিয়ে গিয়েছিলাম মা ঠিক ততোটাই নিরাশ করে পড়তে ফেরত পাঠালেন। শুধু তাই না টিভিও বন্ধ করে দিলেন।
সে রাতে আর পড়া হলো না। ঘুমও ভালো হলো না। মাথার ভেতরে স্ক্রেচ পড়া সিডির মতো কেবল একটি লাইনই বাজতে লাগলো। এর আগে পাশ্চাত্য ঢঙে বাংলা গান শুনেছিলাম কিন্তু কণ্ঠে ধারণ করতে এই প্রথম শুনলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছুটলাম পাশের বাসায় বন্ধুর কাছে। আমি কিছু বলার আগেই সে বলে উঠলো দোস্ত কাল রাতে একটা গান শুনছি টিভিতে, ফাটাফাটি। গানটা কই পাই বল তো? দু বন্ধু মিলে ছুটলাম পাড়ার একমাত্র ক্যাসেটের দোকান সার্প রেকডিং-এর সফি ভাইয়ের কাছে। তিনিও নিরাশ করলেন। বললেন, এটা ‘সুখ’ নামের একটা ব্যান্ডের ক্যাসেটের গান। ধানমন্ডি গুলশানের ছেলে মেয়েরা শোনে। দুই কপি ছিলো। দোকান খোলার সাথে সাথে বিক্রি হয়ে গেছে। এতে আমরা দেবে গেলাম না। নাম তো পাওয়া গেছে। ছুটলাম কচুক্ষেত বাজারে। ক্যাসেট পাওয়া গেলো না সেখানেও। তবে গানটি রেকর্ড করে নেয়া গেলো। গানের শিরনাম ‘চলো বদলে যাই’, অ্যালবাম ‘সুখ’, ব্যান্ড ‘এলআরবি’ এবং ভোকাল আইয়ুব বাচ্চু।
তাঁর আমন্ত্রণে সত্যিই আমাদের কৈশোর বদলে গেলো। এলিফেন্ট রোডের গানের ডালি থেকে খুঁজে বের করলাম এলআরবি’র ডাবল অ্যালবাম। আবিস্কার হলো মাধবী, ঢাকার সন্ধ্যা, গতকাল রাতে’র মতো গান। যা আমাদের রক্তে হার্ট ড্রাগসের মতো ঢুকে গেলো। গানের রিয়েল সাউন্ড পেতে গাড়ির সেট নিয়ে এলাম ঘরের ভেতরে। আনা হলো আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম। শুধু যে আমার বাসায়, তা না। আমরা যারা ততোদিনে এলআরবি’র ভক্ত হয়েছি তাদের সবার ঘরেই। এ থেকে বলা যায় ভালো সাউন্ডে বাঙালির গান শোনার অভ্যেসটা আইয়ুব বাচ্চুই গড়ে দিয়েছিলেন। তবুও, স্বপ্ন , ঘুমন্ত শহরের মতো একের পর এক অ্যালবাম বাংলা ব্যান্ড গানকে নিয়ে যেতে লাগলো অন্য এক উচ্চতায়।
আর ‘কষ্ট’র মতো একক অ্যালবাম ভেঙে দেয় ব্যান্ডের গানের প্রতি এক শ্রেণির মানুষের অনিহার দেয়াল। নব্বই দশকে জগন্নাথ কলেজকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের ঘোষণা আসে (২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়-এর ঘোষণা বাস্তবায়ন হয়)। সেই উপলক্ষ্যে আয়োজন করা হলো কনসার্টের। ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়লো সে খবর। আমরা মিরপুর থেকে ট্রাক ভাড়া করে ছুটলাম দলে দলে। স্মৃতিতে এখনো স্পষ্ট জেমস ভাই তখন মঞ্চে ‘অনন্যা’ গাইছেন। মঞ্চে উঠে পেছন থেকে গিটার ধরলেন তিনি। সেই প্রথম সরাসরি দেখা গিটারের যাদুকরকে। সেদিনই জগন্নাথের মাঠে বসে প্রতিজ্ঞা করি এই শিল্পী দুইয়ের সান্নিধ্য যে কোনো মূল্যেই নিতে হবে। সে যেভাবেই হোক!
পরবর্তীতে আমার গীতিকার হয়ে ওঠার পেছনে হয়তো তাদের এই অবদানটুকো আছে। বলে রাখি আমার লেখা প্রথম গান জেমস ভাই গেয়েছেন। আইয়ুব বাচ্চু গোটা তরুণ সমাজকে মোহাবিষ্ট করে ক্ষান্ত হননি। উনি হয়তো অনুধাবন করেছিলেন শুধু পাশ্চাত্য ধারার গান করে সারা বাংলার সর্ব শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছানো যাবে না। তাই একদিন ধুম করে গেয়ে বসলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে মান্না অভিনীত ‘আম্মাজান’ ছবির টাইটেল সং। রচিত হলো নতুন আর এক ইতিহাস। তারপরে ক’বছর একাই চরম প্রভাব বিস্তার করে রাখেন বাংলা সিনেমার গানে। যদিও আমরা যারা তার ব্যান্ড ইমেজের ভক্ত তারা কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হই বৈকি! তাতে কিছু যায় আসে না তার। নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠেছেন ততোদিনে।
একটার চেয়ে একটা বড় হিট গান। শুধু যে সিনামার গান তাই নয়। বিভিন্ন মিক্সড অ্যালবামে সেমি ক্লাসিক্যাল গান গেয়ে এবং তা টপ চার্টের শীর্ষে পৌঁছে দিয়ে তার মুন্সিয়ানারও প্রমাণ রাখেন। একটা সময় তার ব্যান্ড আর একক ইমেজের মধ্যে দন্দ্ব হয়। যেন নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রিন্স মাহমুদের সাথে গড়ে ওঠে দারুণ এক জুটি। তবে ১২ মাস অ্যালবামে সুপার হিট গানের পর ব্যক্তিগত ইমেজে না হলেও হিট গানে কিছুটা ভাটা পড়ে। বছর দুয়েক পর শওকাত ভাইয়ের সুরে আমার লেখা সখি, এক আকাশের তারা, নদীর বুকে চাঁদ বাংলা গানের শ্রোতাদের মধ্যে আবারো ঝড় তোলে। সেই থেকে আইয়ুব বাচ্চু নামের ঝড় বাংলা গানে রয়েই গেলো।
মৃত্যু হয়তো ব্যক্তি আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠকে রোধ করতে পারে, তাই বলে তাঁর গান কিংবা গিটার? সে তো লক্ষ কোটি কণ্ঠ ও তারের ছোঁয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষিদের কাছে। আজ যে সব তরুণ ব্যান্ড করতে চায় তারা সবাই এলআরবি’র কোনো না কোনো গানে প্রভাবিত। যেখানেই বাংলা গান সেখানেই আইয়ুব বাচ্চু। আমি গর্বিত মহান এই শিল্পীর বেশ কয়েকটি গান লেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। আমি ধন্য আমার জীবনে আমি আইয়ুব বাচ্চু ও এলআরবি’র মতো ব্যান্ড-এর লাইভ কনসার্ট দেখেছি। আইয়ুব বাচ্চুই একমাত্র শিল্পী ৯০ দশকের জেনারেশনকে দুইবার গানে উন্মাদ করেছেন। প্রথমবার ৯০ দশকে যখন তার শিল্পী হিসেবে আবির্ভাব হয়। দ্বিতীয়বার গত বছরে এই দিনে। দ্বিতীয় বারের এই ঘোর আর কাটার নয়। চলছে চলবে শত শত বছর ধরে। যতোদিন বেঁচে রবে বাংলা গান… ততোদিন ধরে।