যুগে যুগে ক্ষমতাবান লোকদের পাশে ঠাঁই করে নিয়েছে তোষামোদকারী চক্র। তারা এসব লোকদের মধুর চাক ভেবে সদা ব্যস্ত থাকে মধু চোষনে। আর সমালোচকরা থাকে অনেক দূরে। কাছে ভেড়ার কোন পথই থাকেনা তাদের। আর ক্ষমতাবানদেরকেও দেখা যায় তোষামোদকারীদের বুকে জড়িয়ে সমালোচকদের বিরুদ্ধে শত্রু পরওয়ানা জারী করতে। শত্রু পরওয়ানা মাঝে মাঝে মৃত্যু পরওয়ানাও হয়ে যায়। অথচ সমালোচনা ও সমালোচকদেরকেই মিত্র ভাবা প্রাকৃতিক বিধান ছিল।
যেমন রোদকে বাধা দেয় বৃষ্টি, জ্যোৎস্নাকে কালো মেঘ, শান্ত বিকেলকে অশান্ত করে সহসা ঝড়, মাটির সমতল ভূমি গুঁড়িয়ে দিয়ে ভূমিকম্প গড়ে তোলে নদী ও জলের স্রোত। এক্ষেত্রে যদি বলা হয় বৃষ্টি, কালো মেঘ, ঝড়, ভূমিকম্প প্রভৃতিকে পৃথিবীতে থাকতে দেয়া হবে না। তা কি প্রকৃতির অবান্তর ও অযৌক্তিক বিরোধিতা করা হবে না? অথচ যুগে যুগে তোষামোদ কারীদের খপ্পরে পড়ে ক্ষমতাবানরা সমালোচকদের বিরুদ্ধ ভূমিকায় নেমে প্রকৃতির এই অমোঘ রীতির বিরোধিতাতেই নামছেন ও জীবন দিচ্ছেন।
সম্রাট জুলিয়াস সিজারের অতি ঘনিষ্ঠ ছিলেন ব্রুটাস। সে যখন সিজারের গলায় ছুরি বসিয়ে দিচ্ছিল তখনও সিজারের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে ব্রুটাস তাকে মেরে ফেলতে পারে। মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ভূমিকাতেও ছিল তাদের ঘনিষ্ঠজনরাই। মহাত্মা গান্ধীকে যেদিন ঘাতক হত্যা করেছিল সেদিনও সে মহাত্মার পায়ে মাথা ঠুকে সালাম করেছিল। মহাত্মা তখনও ভাবতে পারেন নি যে এই নাথুরাম গডসে তাকে খুন করতে পারে। ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করেছিল তারই এক দেহরক্ষী। বঙ্গবন্ধুর কিছু পদক্ষেপের সমালোচনা করতেন তাজউদ্দীন আর সমর্থন ও তোষামোদি করতেন মুশতাক গং। শেষে অবস্থা কি দাঁড়ালো ক্ষমতার বলয় হতে তাজউদ্দীন পিছিয়ে গেল আর মুশতাক গং এগিয়ে গেল। আরও কি দেখলো মানুষ? তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর জন্য নিজের জীবন দিল আর মুশতাক গং খুনী হয়ে জীবন নিল।
যারা যতবেশী তোষামোদ করে ও সুবিধা ভোগ করে তারাই ততবেশী খুনী হয়ে ওঠে এটাই বুঝি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। চরম ট্র্যাজেডি হলো বিশ্বাস ঘাতকদের আসল চেহারা তাদের চোখে উন্মোচিত হয় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ক্ষণে।অথচ জীবদ্দশায় যাদেরকে মিত্র ভাবার কথা ছিল তাদের ভাবা হয় শত্রু আর শত্রুদের মিত্র এটাই পরিহাস।
দল ক্ষমতায় গেলে দলে নতুন নতুন নেতাকর্মী যোগদানের হিড়িক বেড়ে যায়। বেড়ে যায় দলীয় প্রতিষ্ঠাতার জন্মদিন ও মৃত্যুদিনের উৎসবিক আমেজ। বেড়ে যায় পিএস, এপিএস ও নানান সহকারী হওয়ার প্রতিযোগিতা।
সরকারী কর্মচারীদের এখন যে কাউকেই যদি বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপিএস হতে তাৎক্ষনিক ভাবেই তিনি রাজী হয়ে যাবেন। কিন্তু যদি বলা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এপিএস হতে হবে তখন কেউ রাজী হতে চাইবে না। সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরা যে দল ক্ষমতায় যায় সে দলেরই প্রতিষ্ঠাতার জন্মদিন, মৃত্যুদিন পালন করে মহাউৎসবে বিরোধী দল হলে চলে যায় তফাতে। প্রতিটি মন্ত্রী, এমপির সহকারীরা ব্যস্ত হয়ে ওঠে ক্ষমতার হাঁড়ি হতে মধু আহরণে।
শূন্য অবস্থায় এসে তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার ভিত ভরে ওঠে পূর্ণতায়। যারা আগে রিক্সায় ও বাইসাইকেলে চলত পরে তারা চার চাকার গাড়ি হাঁকায়। বেতনভুক্ত ড্রাইভার নিয়োগ করে। রাজধানীতে ফ্ল্যাট-বাড়ি কেনে। দলীয় ত্যাগী নেতা কর্মীদেরকেও তাদের নানা নাগরিক সমস্যার সমাধানে তখন এসব সহকারীদেরই স্মরনাপন্নই হতে হয়। এসব সহকারী নিয়োগে দলের মতামত নেয়া হয় না। যারা স্তুতি করে নেতার ঘনিষ্টজন হতে পারে তারাই এসব পদে নিয়োগ পায়। ক্ষমতার মেইন সুইচ থাকে তাদেরই হাতে।
সম্প্রতি সংবাদ পত্রে খবরের শিরোনাম হয়েছে, টার্গেট ছিল প্রধানমন্ত্রীর বাস ভবন উড়িয়ে দেয়া’চক্রান্তে সরকারী বেতনভুক্ত কর্মকর্তার জড়িত থাকার খবর বেরিয়েছে। চক্রান্ত সফল হলে হয়তো সেও হত ব্রুটাস, নাথুরাম গডসে, মীরজাফর ও মুশতাক চক্রের সফল আরেকজন। এর আগেও বহুবার বিমানে অনেক ষড়যন্ত্রের বিষয় খবরের শিরোনাম হয়েছে। এসব ষড়যন্ত্র সত্যিকারে বাস্তবায়িত হলে কী ঘটতো দেশে? সরকারের নীতিনির্ধারকরা কেন বিমানকে খোল নলচে বদলে ঢেলে যাজাচ্ছেন না? এসব চক্রান্তকারীরা কোন ছদ্মবেশে মিত্রবেশী ঘাতকের ভূমিকায় সক্রিয় রয়েছে?
বিমানমন্ত্রী দায় হতে খালাস এটা মন্ত্রনালয়ের বাইরে বলে। কিন্তু বিমান মন্ত্রনালয়েওতো রয়েছে দায়িত্ব প্রাপ্ত সচিব, মন্ত্রীর বিভিন্ন কর্মকর্তা তারা কী খবর রাখেন বিমানের? তবে কি তারা কেবলই বেতন ভাতা ও ক্ষমতার সুবিধা নেয়ার জন্যই? বিমান মন্ত্রনালয়ের অধীনে নয় তাহলে বেতনভুক্ত নানা কর্মকর্তার কী প্রয়োজন? বিলুপ্ত করা উচিত নয় কি বিমান মন্ত্রী, বিমান সচিবসহ রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী নানা পদ?
বলা হয় বিমান ব্যাংকের মত লিমিটেড কোম্পানি। তাহলে ব্যাংক মন্ত্রী নেই, বিমান মন্ত্রী কেন? ব্যাংকগুলোর মত বিমানকেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে নেয়া উচিত নয় কি? কেন মিত্রবেশী আততায়ী ও সিন্ডিকেটের রাজত্ব সৃষ্টির জন্য এসব নানা পদ? বিমানে নিয়োগ দেয়া হয় ক্যাজুয়েল কার্গো হেল্পার পদে। বেকাররা আবেদনও করে এই পদেই। পরে নিয়োগ কর্তৃপক্ষ তাদের খেয়াল খুশিমত নিয়োগ দেয় ট্রাফিক হেল্পার পদে। এক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অন্যপদে নিয়োগ কি স্বেচ্ছাচারিতার চূড়ান্ত নয়? এগুলোর সমালোচনা করে কে?
একজন সমালোচক ও সাংবাদিককে সহজেই খুঁজে নিয়ে আইনে সোপর্দ করতে পারে যারা জীবনের জন্য ঝুঁকি নয়। কিন্তু যারা শুধু জীবন নয় গোটা দেশ ও জাতির জন্য ঝুঁকি তারা সরকারের টাকায় খেয়ে পরে ও গাড়ি হাঁকিয়ে বিলাসী জীবন পার করছে আর ষড়যন্ত্র করছে তাদের খবর গোয়েন্দা বিভাগও রাখে না! তারা কেবলই খবর রাখে কোন সাংবাদিকের সংবাদ সরকারের বিরুদ্ধে গেল ও কোন রাজনৈতিক সমালোচকের সমালোচনা সরকারের বিরুদ্ধে গেল এসব খবর।বাংলাদেশে একের পর এক সাংবাদিক নিখোঁজের ঘটনা ঘটছে। এসব সাংবাদিক ও সমালোচকরা কি সরকার ও দেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ন? হলে তা কিভাবে।
রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, পূর্ণিমা, অমাবস্যা যদি প্রকৃতিতে পরিত্যাজ্য হতে পারে তবে সমালোচনাও রাজনীতি হতে পরিত্যাজ্য হতে পারে। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় ছাড়া কি প্রকৃতি টিকবে? যদি টিকে তবে রাজনীতিও টিকবে। না টিকলে রাজনীতিও টিকবেনা। এক্ষেত্রে যদি বলি রাজনৈতিক সমালোচকদের পরিত্যাজ্য করার মানে রাজনীতিকে পরিত্যাজ্য করা, তা কি অত্যুক্তি হবে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)