চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

যান্ত্রিকতা কেড়ে নিয়েছে শিশুদের সব বিনোদন

শিশুটির নাম সুপ্রভাত। বয়স ১১ বছর।পড়ছে বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে। সকাল ৬ টায় ঘড়ির অ্যালার্মের সঙ্গে ঘুম ভাঙ্গে তার। কোনরকম রেডি হয়েই ঘুম চোখে দিতে হয় স্কুলের পথে ছুট। সকালের নাস্তাও সারতে হয় স্কুলে যাবার পথে। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে টিচারের কাছে পড়া।বিকেলে ছবি অাঁকা শিখতে যাওয়া। নাচের স্কুলে যাওয়া, সেখান থেকে ফিরে আরবি টিচারের কাছে পড়া শেষে আবার মায়ের কাছে পড়তে বসা।

শুধু সুপ্রভাত না। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ শিশুরই এমন রুটিন বেঁধে চলতে হয়। ঘড়ির কাঁটাই ঠিক করে দেয় তাদের কাজ। যান্ত্রিকতার এই শহর কেড়ে নিয়েছে কোমলমতি শিশুদের শৈশব। এখন তারা ইচ্ছে হলেই ছুট দিতে পারেনা খোলা মাঠে। ধূলো গায়ে মধ্য দুপুরে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়তে।

খেলাধূলা শৈশবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও পর্যাপ্ত মাঠ, খেলার জায়গার অভাব,  আর সময়ের স্বল্পতার জন্য তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা। সরকারী স্কুলগুলোতে খেলাধূলার পর্যাপ্ত  জায়গা থাকলেও বেসরকারি স্কুলগুলোতে নেই সে ব্যবস্থা। সেখানে একটি ফ্ল্যাট বাড়ির মাঝেই চলছে শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম। ফলে সেখানেও খেলার পরিবেশ পাচ্ছেনা কোমলমতি শিশুরা। তাই চারদেয়ালের মাঝে  ছবি এঁকে , টিভি দেখে, গেইম খেলেই সময় কাটাতে হচ্ছে তাদের।

এসব শিশুদের কারো কারো ছবি অাঁকা অনেক পছন্দের কাজ। তাদের ছবি আঁকার খাতা উল্টোতেই চোখে পড়ল গ্রাম বাংলার দৃশ্য। জানা গেল গ্রাম তাদের  অনেক প্রিয়। গ্রামে গেলে অনেক ভাল লাগে। উচ্ছ্বাস নিয়ে গ্রামের বড় বড় খোলামাঠে দিনভর খেলে বেড়ানোর আনন্দের কথাও জানায় তারা।

এসব শিশুদের অনেকে আবার কখনোই গ্রাম দেখেনি। ছবিতে আর বইয়ে যেভাবে গ্রামের দৃশ্য দেখেছে তাদের চোখে গ্রাম ঠিক তেমনই।

শিশুদের অনেকে বদ্ধ জীবনে থাকতে থাকতে হয়ে পড়ছে ঘরকুণো। বাহিরের জগৎ থেকে হয়ে পড়ছে বিচ্ছিন্ন। এ বিষয়ে শিশু সাবাবের মা বলেন, ‘সাবাবের বয়স ৫ বছর হলেও সে এখনো কথা বলেনা। বাহিরে যেতে ভয় পায়। বাহিরে নিয়ে গেলেও কোল থেকে নামতে চায়না। বেশি মানুষ দেখলে চিৎকার করে শুরু করে কান্না।

খেলার জায়গা নেই তাই বাসার ভেতরেই সাইকেল চালাচ্ছে শিশু সামি

শহুরে শিশুদের বেশিরভাগের জীবনই ৬০০ থেকে ১৫০০ বর্গফুটের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিশেষজ্ঞরা একে মারাত্মক বিপদের কারণ হিসেবে দেখছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের খেলার জায়গার অপ্রতুলতা, গৎবাঁধা যান্ত্রিক জীবন তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে বিপদের দিকে। ফলশ্রুতিতে তাদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। এর মধ্যে রয়েছে মুটিয়ে যাওয়া, একা থাকার প্রবণতা, সমাজ বিচ্ছিন্নতা অন্যতম। বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ।এর কারণ হিসেবে তারা বিদ্যালয়ের পড়াশোনার চাপ সহ অপরিকল্পিত নগরাণকে দায়ি করছেন।

খেলার মাঠের অপ্রতুলতা, যান্ত্রিক জীবনে সময়ের স্বল্পতার কারণে বেশিরভাগ শিশুর এখান সময় কাটছে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ও মোবাইল ফোনের গেইমগুলোর সঙ্গে। গেইম খেলেই কাটছে তাদের অবসর। অার তাই বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে বেনটেন, ব্যাটম্যান, স্পাইডার ম্যান, ডোরেমন, সুজুকা, অ্যাংরি বার্ড আর টিম্পল রানের ভুতের সঙ্গে। বাস্তবের রক্ত মাংসের মানুষগুলোর চেয়ে ভার্চুয়াল জগতের চরিত্রগুলোকেই   মনে হচ্ছে অনেক বেশি আপন। যা তাদের জীবনাচারণেও প্রভাব ফেলছে।

শিশু নাবিলের মা বলেন, ‘স্পাইডার ম্যানকে অনুকরণ করে দেয়াল বেয়ে উঠতে যেয়ে মারাত্মক আহত হয় শিশু নাবিল। তবুও সে বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে।’

শিশু মাহির মুগ্ধ চোখে আকাশ দেখছে

শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুদের শারীরিক গঠনের জন্য খেলাধূলা খুব প্রয়োজনীয়। এই খেলাধূলা থেকে যখন তারা বঞ্চিত হচ্ছে তখনই ঝুঁকে পড়ছে টেলিভিশন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার আর মোবাইলের দিকে। অধিক মাত্রায় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে তাদের চোখ। মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে মেরুদন্ডের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। দেখা দিচ্ছে কব্জি  ও হাতে ব্যথাসহ হচ্ছে নানা শারীরিক জটিলতা।

এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে সমাজবিজ্ঞানী নেহাল করিম বলেন, বর্তমানে যেভাবে প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়ে শিশুদের বেড়ে উঠতে হচ্ছে সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার কোন উপায় নেই। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং মা-বাবারা কিছুটা সচেতন হলেই কিছুটা হলেও সম্ভব এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া। এজন্য নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে স্কুলগুলোতে খেলাধূলার আয়োজন সহ। পিতা- মাতাদের সন্তানদের ছুটির দিনটিতে অন্তত একটু খোলা পরিবেশে নিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।