একজন শিল্পী ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হতে পারেন। নাও হতে পারেন। না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাতে কিছু যায় আসেনা। একজন শ্রোতার কাছে প্রকৃত শিল্পী কখনও অপরিচিত থাকেন না।
তাঁর গাওয়া গানই তাঁর পরিচয়। জানি, সাধারণত গানগুলো লেখেন গীতিকার। সুর করেন সুরকার।তারপরই কণ্ঠ দেন শিল্পী। কিন্তু গানগুলোকে শ্রোতার কাছে পৌছে দেন কণ্ঠশিল্পী। যে কারণে শ্রোতারা তাঁকেই চেনেন। জানেন। মনে রাখেন।
আর একজন সুবীর নন্দী হলে তো কোনো কথাই নেই। তিনি তো আমাদের কাছের মানুষ। খুবই আপনজন। যে সময়ে গান গেয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন সুবীর নন্দী, সেই সময়টাতে আমাদের অনেকেরই বেড়ে ওঠা। আমাদের মন-মেজাজ, স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তিনি।
তাঁর সময়ে এ শহরে, এ দেশে এমনকি পরবাসেও যাঁদের বসবাস, তাঁকে তো এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিলনা। তাঁর গান শুনতে হয়েছে। মুগ্ধ হতে হয়েছে। তাঁকে ভালোবাসতে হয়েছে। তাঁর গান প্রতিনিয়ত কোথাওনা কোথাও বেজে চলেছে। বেতারে। টেলিভিশনে। ইউটিউবে। সর্বোপরি তাঁর গান বাজে হৃদয়ের নিভৃতে।
একজন সুবীর নন্দী চলে যাওয়ার পর প্রিয় একজন মানুষের চলে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছে। তাঁর গান রয়ে গেলেও তাঁর চলে যাওয়াটায় কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। মায়াবী এ পৃথিবীতে জীবন যাপন করতে গিয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত কত রকম অনুভব হয়। সেই অনুভব, সেই অনুভূতিগুলো সবার পক্ষে ব্যক্ত করা সম্ভব হয় না।
অনুভূতিগুলোকে চমৎকারভাবে বাঙ্ময় করে তোলেন লেখক, চিত্রকর, শিল্পীরা। সবাইকে ভালো লাগায় ভরিয়ে দেন। ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ে প্রলেপ লাগিয়ে দেন। সুবীর নন্দী তো তাঁদেরই একজন। তাঁর কণ্ঠ কী দারুণভাবে না ছুঁয়ে যায় সংগীত অনুরাগীদের। তাঁর অসংখ্য গান আমাদের আমোদিত করে। আবেগকে স্পর্শ করে। আক্ষেপ হয়ে ঝরে।
কত কত মুহূর্তে তাঁর গান হয়েছে আনন্দ-বেদনার সঙ্গী।সম্পর্কের ক্ষেত্রে কত না উথাল-পাথাল হয়। কষ্টের, বিরহের, যন্ত্রণার। এ অনুভূতিগুলোর সার্থক রূপকারদের একজন সুবীর নন্দী। তাঁর গান আমাদের ভাবায়। কাঁদায়। হাসায়।
‘কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়/দুঃখ হারায়না/কেন স্বপ্ন ভেঙে যায়/মানুষ কথা দিয়ে রাখেনা/আমি যারে আপন করি/সে হয় আমার পর/আমি যারে হৃদয় দেই…।’ এমন অভিজ্ঞতা হওয়ার পর বুকটা কেমন ভেঙে যেতে চায়। এ প্রশ্নের উত্তর যখন কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, প্রশ্ন হয়েই থেকে যায় নিরন্তর, তখন আত্মসমর্পণ করতে হয় এ গানের কাছে।
বুকের মধ্যে ভালোবাসার রং ছড়িয়ে দিতে কিংবা ভালোবাসার মানুষকে যে কথা বলতে ইচ্ছে হয়, সে কথা বলার জন্য সুবীর নন্দীর গানগুলোর তুলনা হয় না। তাঁর গানের লাইনে লাইনে প্রকাশিত হয় হৃদয়ের অনেক না বলা কথা। শুধু কি হৃদয়ের কথা? জীবনের কত ক্ষেত্রেই তো তাঁর গান মিলে যায়। কখনও অনুপ্রাণিত করে। অনুতপ্ত করে। অনুস্মরণ করে।‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো/সে কথা তুমি যদি জানতে/এ হৃদয় চিরে যদি দেখানো যেত/আমি যে তোমার তুমি মানতে…।’ হৃদয় চিরে তো আর দেখানো যায়না। যে কারণে বোঝানো যায়না ভালোবাসা।
তখন বুকের মধ্যে না পাওয়ার বেদনা নিয়ে বেজে ওঠে, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে/একটা কথাই শুধু জেনেছি আমি/পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’।এমন নৈরাশ্যজনক মনোভাব হওয়ার পর কান্নাটাই মনে হতে পারে অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি/আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।
তারপরও কান্নাটাকে, কষ্টটাকে মনে হয় বিভ্রম, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে/তোমরা তাকে ঝর্ণা বলো’। তখনই অন্তঃকরণে মর্মরিত হয়. ‘কারো বুকের দুঃখ নিয়ে কাব্য চলে না’।
তারপর সময় বয়ে যায়। কিন্তু কথা দিয়ে কথা রাখার কষ্ট কি ভুলে থাকা যায়? ‘দিন যায় কথা থাকে/সে যে কথা দিয়ে রাখলো না/ভুলে যাবার আগে ভাবলো না’। কথা দিয়ে কথা না রাখার এ মনোবেদনা থাকলেও পাওয়া যায় বন্ধনে জড়ানোর শান্তনা, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্র/ বলে গণ্য হলাম/তবুও একটা কিছু হয়েছি যে/ তাতেই আমি ধন্য হলাম’।
প্রিয় কেউ যখন দূরে চলে যায়, একদমই ভালো লাগে না। তাকে কাছে পাওয়ার জন্য মনটা আকুলি-বিকুলি করে। ‘পাখিরে তুই/দূরে থাকলে কিছুই আমার ভালো লাগে না/পাখিরে তুই কাছে থাকলে/গানের সুরে পরান দোলে/হৃদয় নাচে সুরের তালে’। এ গানটি শুনলে জেগে ওঠে একটা দুঃখবোধ।
‘যদি কোনো দিন আমার পাখি/আমায় ফেলে উড়ে চলে যায়/একা একা রব নিরালায়…’। হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ে হাহাকার। একা একা থাকা ছাড়া কীইবা করার থাকে? আর একাকী থাকলেও প্রবোধের সুর হয়ে বাজেন সুবীর নন্দী। তিনিই পারেন কষ্ট থেকে, যন্ত্রণা থেকে, না পাওয়ার বেদনা থেকে সাময়িকভাবে হলেও মু্িক্ত দিতে।
‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়/তবুও কেন বয়ে বয়ে যায়’। কেন যায়? এর উত্তর এখন কোথায় পাবো? সুবীর নন্দী, আপনি চলে যাওয়ায় আমরা কাঁদবো না। আপনি সেটা কখনও চান নি। কিন্তু আপনার গানগুলোই তো বুকের মধ্যে কান্না হয়ে বাজছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)