চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

যমুনায় ভাঙ্গন: জিও ব্যাগ অকার্যকর

বর্ষার শুরুতেই ভাঙ্গনের কবলে পড়েছেন যমুনার পূর্বপাড়ের মানুষ। গত এক সপ্তাহের ভাঙ্গনে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ও গোপালপুর উপজেলার ৮ শতাধিক পরিবার নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। যমুনার পূর্বপাড়ের অব্যাহত ভাঙ্গন রোধে এ পর্যন্ত স্থায়ী ও টেকসই কোনো প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেনি কর্তৃপক্ষ।

তবে  চলতি বছরের ভাঙ্গন ঠেকাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়  জিও ব্যাগ ফেলে অস্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এ লক্ষ্যে প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ভূঞাপুর উপজেলার কুটিবয়ড়া থেকে জগৎপুরা পর্যন্ত ৯৪৪ মিটার এলাকা জুড়ে জিও ব্যাগ ফেলার কাজ। কিন্তু তাতে কোনো সুফল পায়নি ভাঙ্গন কবলিত অবহেলিত মানুষগুলো।  প্রশাসনসহ নানা মহলের জটিলতায় জিও ব্যাগগুলি শোপিস হয়ে পড়ে রয়েছে যমুনার পাড়ে। আর সময়মতো জিও ব্যাগ না ফেলায় একের পর এক বসতি গ্রাস করে নিচ্ছে যমুনা।

অন্যদিকে অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্থরা ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ায় নয়-ছয়ের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের প্রতি।

সরেজমিনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ খ্যাত টাঙ্গাইল-তারাকান্দী সড়কের পশ্চিম পার্শ্বে যমুনার কূল ঘেষা ভূঞাপুর উপজেলার প্রাচীন জনপদ চর কুটিবয়ড়া,অর্জুনা, জগৎপুড়া ও গোপালপুর উপজেলার গুলিপেচা, নলীন সোনামুই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙ্গন কবলিতদের চরম দুর্দশা আর অনিয়মের চিত্র। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা ও ভাঙ্গন কবলিত এলাকার ২৮৭৬ টি পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত পরিবার প্রতি ৩০ কেজি চাল পাননি অধিকাংশ পরিবার।

এবারের ভাঙ্গনে গুলিপেচা গ্রামের ৩০টি পরিবার নদী গর্ভে বিলীন হলেও কোনো পরিবারেই জোটেনি কোনো ধরনের সাহায্য। ওই গ্রামের ৯০ বছরের বৃদ্ধা কুলসুম বেগম অভিযোগের সুরে বলেন, ‘আমগোর যে নাম লেইখা নিয়া গেল তার কাম কই?’

একই গ্রামের ৫০ বছরের জোবেদা বেগম বলেন, ‘আমার যহন বিয়া অয় তহন শখ কইরা নদী দেখাবার চাইলে ৮-১০ কিলোমিটা হাটন লাগতো। হেই শখের নদীই ২-৩ বছরের মধ্যে ভিটা-মাটি ছাড়া করলো’

তিনি আরো বলেন, সরকার যদি আগে ব্যবস্থা নিতো তাইলে আমগোর ভিটে-মাটি যমুনায় খাইতো না।’

এদিকে তীব্র ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে ভূঞাপুরের প্রাচীনতম অঞ্চল অর্জুনা গ্রাম। এ গ্রামে একটি  সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয়, একটি কলেজ, একটি বাজার ও বেশ কয়েকটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই গ্রামটি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অধিকাংশ সময়ই মুক্তাঞ্চল হিসেবে ছিলো। এ গ্রামেরই একটি বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা গড়ে তুলেছিলো অস্থায়ী অফিস। ওই বাড়ির লোকদের তথ্যমতে, এই বাড়িকে কেন্দ্র করে কাদেরিয়া বাহিনীর বে-সামরিক প্রধান আনোয়ারুল আলম শহিদ ও নূর নবীগণ ভারত এবং  বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।

গত এক সপ্তাহের ভাঙ্গনে ১৫০টি পরিবার  যেমন বাস্তুহীন হয়েছেন, তেমনি ভাঙ্গন থেকে মাত্র দু’হাত দূরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত ওই বাড়িটি।

গত দুই-তিন বছর ধরে অর্জুনা গ্রামটি ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে বলে জানান স্থানীয়ারা। আর এতেই ওই গ্রামের এক-তৃতীয়াংশ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

স্থানীয়ারা আরো বলেন, ভাঙ্গন রোধে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় আর জনপ্রতিনিধিদের জিআর বাণিজ্যে অতিষ্ঠ হয়ে গত বছর গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে একটি বাঁধ দিয়েছিলেন। কিন্তু রাক্ষসী যমুনার কাছে তাদের সেই চেষ্টা বিফলে যায়।

এবার বর্ষার ভাঙ্গন রোধে এই গ্রামের সরকারী প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্বাবধায়নে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ৯৪৪ মিটার এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলার কাজ বাস্তাবায়ন করছে।

কিন্তু প্রশাসনসহ নানা মহলের স্বদিচ্ছার অভাবে সঠিক সময়ে জিও ব্যাগ না ফেলায় ভাঙ্গন ঠেকানো সম্ভব হয়নি। যার ফলে প্রতিদিনই গৃহহীন হচ্ছেন একের পর এক পরিবার। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে প্রাণহানীর। তেমনি বাড়ি ভাঙ্গার শোকে হার্ট ফেইল করে অজ্ঞান হয়ে যান অর্জুনা গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হাবিবুর রহমান (৫৫)।

এ বিষয়ে হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের বাড়িটি একশ বছরের পুরাতন। বাড়িটি যখন ভাঙ্গে তখন আমি হার্ট ফেল করে অজ্ঞান হয়ে যাই। হাসপাতালে চিকিৎসার নেয়ার পর এখন একটু সুস্থ আছি। কিন্তু যেভাবে বেঁচে আছি তাকে থাকা বলে না। জমি-জমা হারিয়ে শেষ হয়ে গেছি। এক সময় আমাদের সব ছিল। এখন অন্যের বাড়ির উঠোনে আশ্রিত। আশ্রিত বাড়িটি আগামী কালের ভাঙ্গনে থাকবে কি’না বলতে পারি না। যদি না থাকে তাহলে কোথায় যাবো?

তিনি বলেন, আমার মতো এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষের একই অবস্থা। সঠিক সময়ে যদি ব্যবস্থা নেয়া হতো তাহলে নদী ভাঙ্গন ঠেকানো যেতো। এখনো যে কয়টি পরিবার টিকে আছে তাদের জন্য সরকার যেন দৃষ্টি দেয়।

একই গ্রামের শাহাদত হোসেন খান বলেন, আমরা ঈদ করতে পারি নাই। ঈদের দিন আমাদের বাড়ি-ঘর অন্যত্র নিতে হয়েছে। ঠিকাদার হাজার হাজার জিও ব্যাগ বালু ভর্তি করে মজুদ করে রাখছে। যদি তা মজুদ না করে নদীতে ফেলত তাহলে আমাদেরকে বাপ-দাদার ভিটে ছাড়া হতে হতো না।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তুহিন বলেন, সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক সরকারি লোকের তত্বাবধায়নে কাজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। তাদের উপস্থিতি ছাড়া ব্যাগ নদীতে ফেলা বারণ। আমরা এখন পর্যন্ত ৩০ হাজারে অধিক জিও ব্যাগ ফেলেছি। অন্য খালি ব্যাগগুলি চ্যাপিং কাজে ব্যবহারের জন্য। চুরি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় নিরাপদ একটি স্থানে মজুদ রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের টাঙ্গালের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজান সিরাজ বলেন,  ঈদের ছুটি ও লেভার সংকটের কারণে জিও ব্যাগ ফেলার কাজ বন্ধ ছিলো। এ কারণে কিছু এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দিতে পারে। ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হচ্ছে।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার তালিকা মোতাবেক গোপালপুরে ১ হাজার ৭শ’ ১৮ জন পরিবার ও ভূঞাপুরে ১ হাজার ১শ’ ৫৮ জন পরিবারকে ৩০ কেজি করে চাল বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। নতুন করে কোনো পরিবার  ক্ষতিগ্রস্থ হলে পরিস্থতিতি মোকাবেলার জন্য আমাদের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ আছে। তাছাড়া চাল বিতরণে কোনো অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।