“হাসপাতালে চাকরি দিবো, ত্রিশ হাজার ট্যাকা বেতন। এই কথা শুইনা ট্যাকা যোগাড় কইরা গেলাম দুবাই। এয়ারপোর্টে এক সাহেব দেখলাম আমার ছবি নিয়া দাঁড়ায়া আছে। আমি হেগো সাথে গাড়িত উঠলাম। উঠার পর দেখি উনি আর উনার সাথের আরেকজন খুব হাসতাছে। আমার বুকের ভিতরে চিরিক দিলো। তবে হেগো বাড়িতে যায়া এক ম্যাডামরে দেইখা শান্তি লাগলো। ভাবলাম এই বাড়িতে কাম কইরা দেশে আমার পোলা আর আমার প্যারালাইজড ভাইয়ের জন্য ট্যাকা পাঠাইতে পারুম। ওই বাড়িতে আমারে প্রথমেই গোসল করাইলো। এরপর পিন্দনের জন্য একটা কাপড় দিলো। হেই কাপড় এতো পাতলা যে সব দেখন যায়। পিনতে চাই নাই দেইখা মারলো আমারে, আমি পিনলাম। এরপর আমার রুমে যাইতে প্রথমে ওই বাড়ির সাহেবের ছেলে দরজায় ধাক্কা দিলো। খুলতেই সে আমার উপর নির্যাতন শুরু করে। ছেলের পর সাহেবও একই রকমভাবে। আমি কাইন্দা তাগো হাতে-পায়ে ধরলাম। হ্যারা কইলো ‘তোরে ট্যাকা দিয়া কিনা আনছি, বাংলাদেশি ট্যাকায় দুই লাখ ট্যাকা। কইলো যা কইবো তাই নাকি শুনতে হইবো।”
টানা ৯ মাস এমন বর্বরতা সহ্য করা বাংলাদেশের ময়নাকে এরপর ১ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়া হয় দুবাইয়ের আরেক বাড়িতে। সেটা আসলে ঠিক বাড়ি ছিলো না বরং ময়নার মতো আরও দুর্ভাগা বাংলাদেশি,ইন্দোনেশিয় নারীদের পশুর মতো আটকে রাখার খোয়ার ছিলো সেটা।
সেখান থেকেই কোনো রকমে দেশে ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ময়না। ভাইকে ফোন করে ময়না বলেন,“ভাইরে আমারে তো মাইরা ফালাইছে,আমারে নিয়া যা,আমারে নিয়া যা। একটা মাস হাসপাতালে আছি, খালি রক্ত পড়ে।”
বোনের এমন আকুল আর্তি শুনে ময়নার ভাই আসেন একটি মানবাধিকার সংগঠনের কাছে। এরপর বহু চেষ্টায় ফেরত আনা হয় ময়নাকে।
রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো বলছিলেন আপাদমস্তক কাপড়ে ঢাকা ময়না। নিজেই জানালেন ঘাড়ে-গলায়,হাতে এখনও আচঁড়-কামড়ের দাগ।
মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে ময়নার মতোই পাশবিকতার শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন জাহান আরা, রোকসানা, ইয়াসমিনরা। ভাষা না বুঝে ছোট ভুলের জন্য প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন এবং প্রতিনিয়ত করা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া এই নারীদের শারীরিক ক্ষতগুলো শুকিয়েছে। কিন্তু মনের দগদগে ঘা শুকায়নি। প্রাণ বাঁচতে ঋণ করে, জমি বিক্রির টাকায় দেশের ফেরার পর শনিবার এক গণশুনানিতে নিজেদের দুর্দশার কথাগুলো শোনান তারা।
সাংবাদিকতা জীবনে প্রায় ১০ বছর এরকম অভাগিনী অভিবাসীদের এরকম দুর্দশা নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন লিখেছেন শরিফুল হাসান। সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়া এই কর্মকর্তা মনে করেন শুনানিতে ময়না, রোকসানারা তাদের ওপর নেমে আসা নির্যাতনের পুরোটা বলেননি, বলতে পারেননি এবং কোনো অনুষ্ঠানে সেসব বলা সম্ভবও নয়।
তিনি জানান,অভিবাসন নিয়ে সাংবাদিকতা করার সময় এবং এখনও তাকে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি গৃহকর্মী নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা শুনতে হয়।
অভিবাসন নিয়ে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন,‘২০১০ সালে একের পর এক ফিলিপিনো নারী নির্যাতনের শিকার হওয়ায় সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয় ফিলিপিন্স। এরপর কয়েকটি প্রতিবেদন করায় বাংলাদেশ থেকেও সাময়িকভাবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ থাকে। কিন্তু ২০১৫ সালে সৌদি আরব শর্ত দিলো নারী গৃহকর্মী না পাঠালে তারা এদেশের পুরুষদের জন্য শ্রমবাজার খুলবে না। এরপর সরকার রাজি হলো। মাত্র ৮’শ রিয়াল অর্থাৎ মাত্র ১৫-১৬ হাজার টাকায় আমরা আমাদের মেয়েদের সৌদি আরবে বিক্রি করে দিতে রাজি হলাম।’
মর্মান্তিক বর্ণনাগুলো মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয় জানিয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন প্রধান বলেন,‘সৌদি আরবে আবার নারী গৃহকর্মী পাঠানো শুরুর এক বছর পর আমি তখন দেড়’শ জন নারীর ওপর করা দূতাবাসের প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করি। দেখলাম এই নারীদের কেউ ধর্ষণের শিকার হয়ে চার মাসের অন্তঃসত্বা, কেউ বিল্ডিং থেকে পড়ে পঙ্গু, কারও কারও চুল টেনে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।’
বিগত কয়েক বছরে বিদেশে যাওয়া নারীদের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন শরিফুল হাসান। জানান,১৯৯১ সাল থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ ৭৪ হাজার নারী শ্রমিক বিদেশ গিয়েছে। এরমধ্যে সাড়ে ৩ লাখই গেছে গত ৩ বছরে। এদের মধ্যে ২ লাখই গেছে সৌদি আরবে।’
মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সৌদি আরবে গৃহকর্মীদের ওপর বর্বর আচরণের পরও সরকার কঠোর পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। তার দাবি,মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী ছাড়া অন্য যেকোনো নিরাপদ কাজে দেশের নারীদের পাঠানো হোক।
অভিবাসীর সুরক্ষায় দেশের কার্যকর উদ্যোগ নেই, স্বল্প উদ্যোগেও আছে ত্রুটি বলে মনে করেন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য রাইটস অব বাংলাদেশি মাইগ্র্যান্টসের (ওয়ারবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক।
তিনি বলেন,‘অভিবাসী শ্রমিকরা দেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে। অথচ তাদের পাঠাতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কোনো দেশের কোনো চুক্তি নেই। কেবলমাত্র সমঝোতার ভিত্তিতে শ্রমিক পাঠানো হয়। শ্রমিকের নিরাপত্তায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। কারও মাথা ব্যাথা নেই।’
বিশেষজ্ঞ প্যানেলে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী। তিনি বলেন, ‘যারা যান, তারা কিছু না জেনেই যান। সব ধরনের নির্যাতনের শিকার হন নারীরা। সব বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশে না যাওয়া এবং এসব বিষয়ে নারীদের সচেতন করতে হবে।’
তবে মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী হিসেবে দেশের নারীদের না পাঠাতে বিশেষজ্ঞদের মতামতের সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত প্রকাশ করে বিচারক প্যানেল।
মধ্যপ্রাচ্যে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে তাদের সেখানে পাঠানো যাবে না এমন সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না বলে মনে করেন গণশুনানীর বিচারক প্যানেল।
গণশুনানির বিচারক প্যানেলে ছিলেন বিচারপতি নাজমুন আরা, বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের আহ্বায়ক মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন।
তাদের মতে, দেশের কর্মসংস্থানের অভাব এবং বেশি আয়ের আশায় নারীরা বিদেশ যায়। তবে তাদেরকে বিদেশে যেতে দেয়ার আগে যেসব দেশে তারা যায় সেসব দেশে তারা যেনো সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
স্বপ্ন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে মধ্যযুগীয় দাসীর জীবন থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা নারী অভিবাসীদের বক্তব্য তুলে ধরা এবং সমাধানের সুপারিশের জন্য এই গণশুনানীর আয়োজন করে ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং নামের একটি বৈশ্বিক ক্যাম্পেইন।
গণশুনানি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ওয়ান বিলিয়ন রাইজিংয়ের সমন্বয়ক খুশি কবীর, সমাজকর্মী সুলতানা কামাল প্রমুখ এবং সঞ্চালনায় ছিলেন উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদক সুপ্রীতি ধর।