আচ্ছা সব পুরুষই কী এক? আমার ভাই, বন্ধু কিংবা অন্যরা? সব পুরুষই কি ভিড়ের ভেতর মেয়েদের শরীর স্পর্শ করতে চায়? আমার ভাই, বন্ধু কিংবা অন্যরা? এই ঢাকা শহরটা দেখলে আমার তেমনই মনে হয়। আর আশপাশের নারীদের গণপরিবহণের অভিজ্ঞতা শুনলে পুরুষ জাতিটাকে পৃথিবী থেকে বিলীন করে দিতে ইচ্ছা করে। একটু বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে গেলাম? যদি তাই মনে করেন, তবে এক সুমির কথা বলি। এই দেখুন এই গল্পটিও আমাকে রয়ে-সয়ে বলতে হবে। না হলে পড়তে পড়তে আপনার পুরুষ মন আবার কুৎসিত মজা নিতে শুরু করবে! তবু আমাকে বলতে হবে। আপনাদের লজ্জা দিতে।
সুমি একজন কর্মজীবী নারী। যে বাস করে পৃথিবীর জঘন্যতম শহর ঢাকায়। প্রতিদিন পুরুষের নোংরা হাত এড়িয়ে বাসে উঠতে হয় তাকে। আমার পরিচিত। একদিন কথা প্রসঙ্গে তার চোখ চিক-চিক করতে দেখেছিলাম। ‘বাসে না চড়লে চাকরি করব ক্যামনে?’ অসহায় সুমি শুধু এতটুকুই বলতে পেরেছিল। ‘প্রতিবাদ করিস না? কষে একটা গালে চড় বসিয়ে দিতে পারিস না?’ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে সুমি উত্তর দেয়, ‘প্রথম প্রথম তাও করতাম। পুরুষগুলো উল্টো বলে আফা, ভিড়ের মধ্যে একটু আধটু গায়ে লাগবোই। এতো চ্যাতেন ক্যান?’ সুমি মিরপুরের ভাড়া বাসা থেকে প্রতিদিন মহাখালী পর্যন্ত বাসে যাতায়াত করে। যে স্যালারি পায় তাতে বাসা ভাড়া, সংসারের যাবতীয় খরচ দিয়ে সিএনজিতে চলাচল সুমির কাছে স্বপ্নের মতো। লোকাল বাসে উঠলে টাকা আরও সেভ হতো। কিন্তু ওসব বাসে ওঠার উপায় নেই। গাদাগাদির ভেতর পা রাখারও জায়গা মেলে না। ভাড়া একটু বেশি লাগলেও লাইনে দাঁড়িয়ে সুমির প্রতিদিনের চেষ্টা থাকে সিটিং বাসে ওঠার। কিন্তু বাসগুলো নামেই সিটিং। সার্ভিস লোকাল বাসের। প্রতিদিন সিট মেলে না। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মিলেও যায় একেক দিন। কিন্তু সিটে বসেও রক্ষে নেই। সিটের পেছনের ফাঁক দিয়ে পুরুষের পায়ের আঙুলের স্পর্শ ঠিকই টের পায় সুমি।
আমি নিশ্চিত, এটা শুধু সুমির প্রতিদিনের গল্প না। এ গল্প ঢাকা শহরের লাখো কর্মজীবী সুমির। যারা প্রতিদিন বাসে চলাচল করেন, তারা ভিড়ের ভেতর পুরুষের লোলুপ হাতের শিকার হননি; এটা কেউ বলতে পারবেন না। এমনকি বাসে ওঠা-নামার সময়ও হেলপার সুযোগ মতো কোমর জাপটে ধরেনি, এটাও মনে হয় কেউ বলতে পারবেন না। আর্থিক সঙ্গতি বাড়ায় এখন আমি সিএনজিতে চলি। কিন্তু ঠিক শুনতে পারি সুমিদের কান্না। কিন্তু সেই চোখের পানি বাবা, মা কিংবা ভাইকে দেখাতে পারে না। মাকে বলা যায়, কিন্তু যদি বলে বসেন, ‘থাক আর চাকরি করতে হবে না।’ তাহলে বাসা ভাড়া আসবে কোত্থেকে? ছোট ভাইয়ের স্কুলের বেতন। বাবার ওষুধ? এমন হতাশার ভিড়ে সেদিন বিবিসিতে পড়লাম ঢাকায় রাস্তায় নারী বাইকারদের সংখ্যা বাড়ছে। এক সময় ঢাকার রাস্তায় এটি ছিল বিরল দৃশ্য।
বিবিসির পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোটরবাইক চালানোর জন্য ২২ হাজার ৭৩৩ জন নারী লাইসেন্স নিয়েছেন। নারীদের বাইক চালাতে শেখায় এমন এক রাইডার্স ক্লাব বলছে, ঢাকায় বাইক চালাচ্ছে ২৫০ জন নারী। বছর খানেকের মধ্যে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলেও মনে করছে রাইডার্স ক্লাবটি। বিবিসির নিউজে নারী বাইকাররা খোলামেলা কথা বলেছেন। সাদিয়া ইসলাম নামে এক গৃহিণী বলেন, রাস্তায় বাইক চালাতে গিয়ে তাকে নানা কথা শুনতে হয়েছে, শুধু পুরুষরাই নন, নারীরা তাকে বলেছেন, এইডা মাইয়া না বেডা। তবুও সাদিয়া গর্বিত। রিকশাওয়ালারা তাকে সাইড না দিলেও হর্ন বাজিয়ে বাইক নিয়ে শা করে ছুটে যান। সাদিয়ার শিশু সন্তানও মাকে নিয়ে গর্বিত। সে প্রতিদিন মার বাইকে চেপে স্কুলে যায়। কখনো মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়।
ছোটবেলায় বাসার জানালা দিয়ে অনেক বাইকার ছেলে দেখতাম। তাদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল মাস্তান টাইপের। জোরে হর্ন বাজিয়ে চলে যেত। বাইকে কারো স্পর্শ পড়লে গায়ে তুলতো। আমি স্বপ্ন দেখি মেয়েরা এই নষ্ট শহরে টিকে থাকতে একদিন বাইকার হবে। যে শরীর থেকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় সেই পবিত্র শরীরে অপবিত্র হাত পড়লে সে বাইকার হয়ে উঠবে। কোনো নরকের কীটের গালে বসে যাবে ডান হাতের পাঁচ আঙুল। মেয়ে তুমি পারবে তো?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)