অফিসে বসের সামনে বসে আছি। ফোনটা টেবিলে রাখা। টুং টুং করে শব্দ হচ্ছে আর একটা করে মাথা উঁকি দিচ্ছে।
ফোনটা টেবিলের ওপর আর আমি ঢুকে যাচ্ছি মাটির নিচে। তিন-চারবার শব্দের পর স্ক্রিনে ভেসে উঠলো “… এর পো, ভাব বাড়সে তোর?”
বিপদ যখন আসে সবদিক থেকে আসে। নোটিফিকেশনের সাউন্ডটা বন্ধ করতে গিয়ে বন্ধুদের বিশেষ গ্রুপের “ভদ্র” ট্রল ভেসে উঠলো ফোনের পর্দায়।
ঘামছি আর নামছি। লজ্জ্বা-শরমের চোরাবালিতে নামছি।
ঘুম ভাঙ্গলো। ভাগ্যিস স্বপ্ন ছিল!
তবে, ম্যাসেঞ্জার নিয়ে দেখা এ স্বপ্ন বাস্তবের খুব কাছাকাছি।
পুরোনো দিনের রানার বা ছোটবেলায় দেখা পোস্টম্যানদের কথা মনে আছে? এদেরকে অলস আর বেকার বানানোর হাজারটা কারণের একটা হলো ম্যাসেঞ্জার। আজ আলাপটা ম্যাসেঞ্জার নিয়ে। স্বপ্ন নয়। এবার পা রাখবো বাস্তবে।
সকালে উঠে মোবাইলটা ধরলেই ম্যাসেঞ্জারে শুভাকাঙ্খীরা রেডি। শুভ সকাল আর সুপ্রভাত পুরো জীবনেও এত শুনি নি, যতটা প্রতিদিন পাচ্ছি ম্যাসেঞ্জারের কল্যাণে! যে কখনও কিছু লেখে না, সেও একটা নদীর অ্যানিমেশন পাঠিয়ে বসে থাকে… এভাবেই শুভ সকালটার শুরু।
দিনের বাকিটা সময় “শেয়ার কর এখনই”,“দশটা শেয়ার চাই কিন্তু”, “না কেঁদে থাকতে পারলাম না” টাইপ মেসেজের সাথে একটা করে ভিডিও। না হলে লিঙ্ক।
এই ম্যাসেঞ্জার তার মহাযাত্রা শুরু করেছে ২০১১ সালে। সাত বছরে ম্যাসেঞ্জারের ব্যাবহারকারী ছাড়িয়েছে ১২০ কোটি!
আর জানিয়ে রাখি, যারা মনে মনে ভাবছেন ফেসবুকের সাথেই তো… উহু। না। ম্যাসেঞ্জার সম্পূর্ণ আলাদা সার্ভিস। ফেসবুক ব্যবহার না করেও কেউ দিব্যি চালাতে পারেন ম্যাসেঞ্জার।
কি নেই ম্যাসেঞ্জারে? টেক্সট, ছবি, ভিডিও পাঠানো, ভয়েস কিংবা ভিডিও কল, লোকেশন শেয়ারিং… আরও কত কি!
নেই শুধু একটা জিনিস। পাঠানো মেসেজ এর লাগাম টেনে ধরার ক্ষমতা। বন্দুকের গুলি আর মেসেঞ্জারের বুলি…একবার ছুড়লে খেল খতম।
সেদিন আমারই এক কাছের ছোটো ভাই লেখলো, “বুবু, আমি রাজশাহী যাচ্ছি”। আকাশ থেকে পড়লাম। আমি আবার বুবু হলাম কবে থেকে! সাথে সাথেই দুঃখ প্রকাশের মেসেজ এল। আর আমি একটা লাইক মেরে চলে গেলাম।
এই লাইক মারা নিয়েও আছে কথা। যখন সময় কম থাকে তখন কিছু লেখার পরিবর্তে ছোটো একটা লাইক মেরে দৌঁড় দেই। এর ফল আবার ভাল হয় না কখনও কখনও। এই যেমন সেদিন, একজন জিজ্ঞেস করল, “আমি কি দেখা করতে আসবো?”
ব্যস্ততার মধ্যে দিলাম লাইক। পরে চিন্তা করে দেখলাম, “এই লাইক দিয়া উনি কি করিবেন বা বুঝিবেন?”
ফেসবুকের নীল বিষ নিয়ে লেখবো অন্যদিন। মেসেঞ্জারেরটাও কম না।
ঘুম, জাগরন, খাওয়া, ক্লাস, অফিস…
টুং…টুং…টুং। এখন আর সত্যিকারের শব্দ হওয়া লাগে না। অটোমেটিক কানে বাজতে থাকে মেসেঞ্জারের শব্দ। সেদিন তো বাসার কলিংবেল শুনে মোবাইলের দিকে হাত বাড়িয়েছি পর্যন্ত!
সব তো বুঝলাম। মেসেঞ্জারে শান্তি মতো চ্যাট তো করা যায়। শান্তি নাই রে ভাই! স্ক্রিনশট নামের কালপ্রিট ঘুম হারাম করেছে সবার। তবে সুবিধাও আছে। বেশ কিছু নোংরা মনের খোলশ টেনে খুলেছে মেসেঞ্জার আর স্ক্রিনশটের যুগলবন্দী।
অন্যরকম অভিজ্ঞতা বলি। মেসেঞ্জারে কল করে কাউকে না পেলে ঠিক পরপরই রেকর্ড হতে থাকে ভয়েস মেসেজ। একজন কল দিয়েছিল। ধরতে পারি নি। এরপর তার অজান্তে হওয়া রেকর্ডে শুনতে পেয়েছি তার দোকানের হিসাব-কিতাব। এটুকুই বা কম কি?
মেসেঞ্জার কলে ইদানিং অগমেন্টেড রিয়েলিটি নামের একটি অপশন চালু আছে। ইচ্ছেমতো কুকুর, বিড়াল, খরগোশ সাজা যায়। এমনিতেই বিউটি ফেসের জামানায় আসল চেহারা লুকোতে ব্যস্ত সবাই। তার ওপর এখন মানবসত্ত্বাকেই লুকোনোর চেষ্টা। ভালো তো।ভালো না?
লেখা আর বড় না করি। শেষ করবো একটা প্রস্তাব দিয়ে। মেসেঞ্জারের ইনবক্সের নামটা চেঞ্জ করে আউটবক্স রাখলেই ভালো হয়। কারণ, আপনি মেসেঞ্জারে ঢুকলেই জেনে যাচ্ছে সবাই, মেসেজ পড়লেই নজরে আসছে সেন্ডারের। যার যখন ইচ্ছে মেসেজ দিচ্ছে, কল দিচ্ছে। দিবস আর উৎসব এখন বিভিন্ন মেসেজের কারণে আতঙ্কের নাম। ভদ্রতা করে সবাই চুপ আছে। কিছু বললে যদি সে অসামাজিক হয়ে যায়! শত হলেও এটা “সামাজিক” যোগাযোগের মাধ্যম।
আর একটা কথা।আপনাকেই বলছি।
আপনি মেসেঞ্জারে ঢোকার সাথে সাথে যখন দেখায় “Active Now”, খুশির কিছু নেই। বাস্তব জীবনে তখন আপনি “Passive Now”।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)