লিওনেল মেসির ফুটবল জীবনের প্রতিটি পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে রুপ-রঙের অপূর্ব খেলা। ফুটবল মাঠে অনেকেই যা পারেননি, মেসি সেটা পেরেছেন। তার একক নৈপূণ্যের কাছে সবাই যেনো ম্লান।
আর্জেন্টিনার পক্ষে একটি কাপ না জেতার আক্ষেপ আর অপূর্ণতাকে বাদ দিলে মেসি যেনো সবই মুঠোবন্দী করতে সমর্থ হয়েছেন। একের পর এক কত স্বীকৃতি আর রেকর্ড এখন তার দখলে!
ফুটবল লড়াই-এর অপার সৌন্দর্য গোল। ফুটবল গোলের খেলা। দিন শেষে ফুটবলে গোলই যেনো সব। গোল ছাড়া ফুটবল ম্যাচ বরাবরই ম্যাড়মেড়ে মনে হয়। গোল দেখার জন্যই ফুটবল দর্শকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন। ফুটবলে যত ধরনের গোল কোটি কোটি দর্শকদের রোমাঞ্চিত করে এর মধ্যে অন্যতম ‘ডিরেক্ট ফ্রি কিক’।
ফুটবলের আইনে প্রত্যক্ষ বা সরাসরি কিকে যে গোল হয়। তবে এখানে ফিফার কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী ডিরেক্ট ফ্রি কিকের বেলায় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ৯.১৫ মিটার বা দশ গজ দূরে দাঁড়ানোর অনুমতি রয়েছে। ফ্রি কিক রুখতে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা গোলকীপারকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বরাবরই ওয়াল তৈরি করেন। আর যিনি কিক নেন তিনি খুঁজেন নির্ভুল নিশানা।
মেসির ফ্রি কিকের গল্প নতুন নয়। তার অলোৗকিক সব ফ্রি কিকের রুপচ্ছটা ফুটবল দর্শকরা অনেকদিন ধরেই দেখে আসছিল। তার ফ্রি কিক বরাবরই ‘ট্রেডমার্ক’ হিসেবেই গণ্য। বহু বহুবার প্রমাণ করেছন নির্ভুল নিশানায় তিনি অনন্য। ফ্রি কিকের ইমপ্রেসিভ ডিসপ্লেতে তার জুড়ি মেলা ভার।
কিন্তু সমসাময়িক সময়ে ঝড় তুলে সবার নজর কেড়ে পরিসংখ্যানে তিনি এগিয়ে যাবেন- সেটা অনেকের ভাবনাতে হয়ত ছিল না। কিন্তু মেসি বলে কথা! ফ্রি কিকের রেকর্ডটা মেসি দখলে নিলেন ৪ জুলাই রোববার সকালে কোপা কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলায়।
এদিন ইকুয়েডরের মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। ডি-পল এবং মার্টিনেজ দুই গোল করে দলকে এগিয়ে রাখে খেলার ৮৪ মিনিট পর্যন্ত। ম্যাচ প্রায় অন্তিম লগ্নে। কিন্তু মেসির জন্য মাহেন্দ্রক্ষণ আসে অতিরিক্ত সময়ের খেলায়। শেষ বাঁশি বাজার কিছু আগে ডি-মারিয়াকে ফাউল করার অপরাধে ব্রাজিলিয়ান রেফারি উইলটন সামপিও ভিএএর (ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি) দেখে আর্জেন্টিনার পক্ষে ফ্রি কিকের সিদ্ধান্ত দেন।
গোলকীপার হারনান গালেন্ডেজ এর সামনে ইকুয়েডরের সব খেলোয়াড় ওয়াল করে দাঁড়িয়ে পড়ে মেসিকে রুখতে। কিন্তু মেসির বিদ্যুৎ গতির চোখ ধাঁধানো শট ইকুয়েডরের গোলপোস্টের টপ রাইট দিয়ে জালে জড়িয়ে পড়ে। এই গোলে মেসির ফ্রি কিকে গোলের সংখ্যা ৫৮তে পৌঁছে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যান।
ইকুয়েডরের বিপক্ষে মেসির নির্ভুল ফ্রি কিকের গোল নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। মেসি বিরোধীরাও অভিবাদন না জানিয়ে পারছেন না। সমসাময়িক কালের পরিসংখ্যানে মেসিই এখন ফ্রি কিক থেকে প্রাপ্ত গোলে সেরা। কোপাতে ইকুয়েডরের মধ্যেকার আগের ম্যাচে চিলির বিপক্ষেও তিনি ফ্রি কিক থেকে আরেকটি রুপময় গোল উপহার দেন।
খেলার ৩৩ মিনিটে ২৫ গজ দূর থেকে নেওয়া শটে মেসি চিলির গোলকীপার ক্লাউডিয়া ব্রাভোকে পরাস্ত করেন। মেসি এ যাবৎকালের ৫৮ ফ্রি কিক গোলের মধ্যে ৫০টি করেছেন বার্সালোনার পক্ষে, বাদবাকি ৮টি দেশের পক্ষে। আর এবারের কোপা কাপেই করেছেন দুটি দৃষ্টিনন্দন ফ্রি কিক গোল।
সমসাময়িক কালে ফ্রি কিক-এর লড়াই-এ মেসির পরেই রয়েছেন ফুটবলের আরেক মহাতারকা পুর্তগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। তিনিও অবশ্য কম যাননি। পরিসংখ্যানে খুব একটা পিছিয়েও নেই। রোনালদো এ পর্যন্ত ফ্রি কিক থেকে মোট ৫৬টি গোল করেছেন। এর মধ্যে নিজ দেশের পক্ষে করেছেন ১০টি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পক্ষে করেছেন ১৩টি, রিয়েল মাদ্রিদের পক্ষে করেছেন ৩২টি, আর সর্বশেষ জুভেন্টাসের পক্ষে করেছেন ১টি গোল। এই দুই জনের ধারের কাছে সমসাময়িকদের মধ্যে আর কেউ নেই। সবাই যোজন যোজন দূরে।
একটু দেখা যাক এ দুজনের পেছনে কে কে আছে। তুরস্কের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হাকান চানাহানোলুর আছেন তৃতীয় স্থানে। ফ্রি কিক থেকে তাঁর গোল সংখ্যা মাত্র ২৭। এরপরে ২৬ গোল করে চতুর্থ স্থানে রয়েছেন বসনিয়ার মিডফিল্ডার মিরালেম পিয়ানিচ। ২২ গোল করে পঞ্চম স্থানে সার্বিয়ার ফ্রি কিক মাস্টার আলেজান্দার কোলারেভ।
এতক্ষণ যাদের কথা বললাম এরা কিন্তু আবার উত্তরসূরিদের থেকে এখনও অনেক অনেক পিছিয়ে। শীর্ষ দশে উল্লিখিত কারোরই এখনও ঠাঁই হয়নি। কবে ঠাঁই হবে সেটা গলা বাড়িয়ে বলার অবকাশ নেই।
ফ্রি কিক এর গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসে ৭৭ গোল করে সবার সেরা ব্রাজিলের জুনিনহো পারমানবুকানো। একসময় ব্রাজিলের মধ্যমাঠের নয়নতারা ছিলেন। ক্লাব পর্যায়ে দীর্ঘদিন খেলেন ফ্রান্সের অলিম্পিক লিও এবং নিজ দেশের ভাস্কো দা গামা ক্লাবে। এই ক্লাব থেকেই ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে অবসর নেন ২০১৪ সালে।
জুনিনহোর করা ফ্রি কিক-এর ইতিহাস এখনও অক্ষত। জুনিনহোর পরে ধারাবাহিকভাবে রয়েছেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি পেলে (গোল ৭০), আর্জেন্টিনার ভিক্টর লেজেরোতাজলিয়ে (গোল ৬৬), ব্রাজিলের রোনালদিনহো (গোল ৬৬), ইংল্যান্ডের ডেভিড বেকহ্যাম (গোল ৬৫), আর্জেন্টিনার ডিয়াগো ম্যারাডোনা (গোল ৬৫), ব্রাজিলের জিকো (গোল ৬২), হল্যান্ডের রোনালড কোয়েম্যান (গোল ৬০), ব্রাজিলের মার্সেলিনহো কারিওকা (গোল ৫৯) এবং ব্রাজিলের রোজারিও কেনি (গোল ৫৯) ।
তবে আরও কিছু কথা আছে। মেসি সমসাময়িককালে ফ্রি কিকের পরিসংখ্যানে এগিয়ে থাকলেও চুলচেরা বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে কিংবদন্তি ম্যারাডোনার থেকে তিনি পিছিয়ে আছেন শতাংশের হিসেবে। কেননা মেসি এ যাবৎ যে ৭৪৮টি (জাতীয় দল এবং ক্লাব মিলিয়ে) গোল করেছেন তার মাত্র ৭.৭৫ শতাংশ গোল এসেছে ফ্রি কিক থেকে।
অন্যদিকে ম্যারাডোনা তার ফুটবল ক্যারিয়ারে যে ৩৫৩টি গোল করেন সেখানে ফ্রি কিক থেকে গোল এসেছে মোট গোলের ১৭ শতাংশ। এবার বুঝুন ফ্রি কিকে কতোটা অগ্রগামী ছিলেন ম্যারাডোনা! শুধু এই নয়, নান্দনিকতার বিচারে ম্যারাডোনার ফ্রি কিকগুলোর গোল নাকি ফুটবলমোদীদের হ্নদয়ে সবচেয়ে বেশি গেঁথে আছে।
ফ্রি কিক নিয়ে যত রেকর্ড হোক আর কথাবার্তা হোক ব্রাজিলের রবার্তো কার্লোস ঐতিহাসিক ফ্রি কিকের কথাও কিন্তু মনে করতে হবে জনম জনম ধরে।
৯৭ সালের ৩ জুন ব্রাজিল এবং ফ্রান্সের সাথে খেলায় রবার্তো কার্লোস ৪০ গজ দূর থেকে বুলেট কিকে গোল করেছিলেন। পরিবর্তিতে ফুটবল বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন এটি মিরাকল। এত দূরত্ব থেকে কেউ গোল করতে পারেননি। নিখুঁত নিশানায় একটি কিকে এত পাওয়ার কখনই দেখা যায়নি।
এবার একটু দেশের কথা বলি। ঢাকার মাঠে এনায়েত, চুন্নু, আসলাম, কায়সার হামিদ, মুন্নার ফ্রি কিকের কথা কিন্তু আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়নি।
তবে আন্তর্জাতিক ম্যাচে সম্ভবত আশরাফ উদ্দিন চুন্নুর ফ্রি কিকে গোলের সংখ্যাই বেশি। ৮৫ সালে ২ এপ্রিল ঢাকাতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের খেলায় ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে চুন্নুর ব্যানানা ফ্রি কিকের গোল এখনও এক মহা ইতিহাস।
তবে আশরাফ উদ্দিন চুন্নু বলেছেন ৮২ সালে পাকিস্তানের করাচিতে কায়েদা আজম ট্রফিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে তিনি ফ্রি কিক থেকে অসাধারণ একটি গোল করেছিলেন।
আরও যোগ করেন ৮৫ সালে মারদেকা কাপে সাউথ কোরিয়ার বিপক্ষেও তার করা ফ্রি কিক থেকে একটি গোল এসেছিল। কায়সারের হামিদের ফ্রি কিকের জোরে অনেকবারই পরাস্ত হতে হয় আবাহনীকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)