চার বছর পেরিয়ে গেলো, কিন্তু এখনো কিনারা হলো না সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের। সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার সাংবাদিক মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শুরু হওয়া তো দূরের কথা, তদন্তই শেষ হয়নি এখনো। বের হয়নি খুনের কারণও।
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করে ঘাতকদের গ্রেফতারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ওই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। সেখানে আজ ৪৮ মাস হয়ে গেলো। প্রথমে থানা পুলিশ, পরে ডিবি, অবশেষে র্যাব। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হলেন একাধিকবার। খুনের আলামত গেলো সেই আমেরিকা পর্যন্ত। ডিএনএ পরীক্ষা শেষে রিপোর্ট ফিরেও এলো তদন্ত সংস্থার হাতে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
হত্যার দু’দিনের মাথায় সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার জানান, হত্যাকাণ্ডের ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে। এর কয়েকদিন পরই ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল ইসলামও হত্যাকাণ্ডের ‘মোটিভ’ নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে মন্তব্য করেন।
অথচ এরপর দীর্ঘ চার বছর কেটে গেলেও সেই ‘মোটিভ’ আলোর মুখ দেখেনি। ‘প্রণিধানযোগ্য’ সেই অগ্রগতির খবর জানতে পারেনি কেউ। এ নিয়ে হতাশ সাগর-রুনির পরিবার ও সাংবাদিক বন্ধুরা।
সাংবাদিক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, অপরাধ দমনে কেনো অপরাধটি ঘটলো তার কারণ বের করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে। সাগর-রুনির ক্ষেত্রে সরকার যে তা করতে পারেনি সেটা খুবই দুঃখজনক।
তদন্ত যেভাবে এগোচ্ছে তাতে কতোদিনে তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে আমজাদ হোসেন বলেন, ‘সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে এ সরকারের একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সরকারের কাছে তারা বার বার তাগাদা দিতে পারেন। সরকারের কাছ থেকে অন্তত এই নিশ্চয়তাটা তাদের নেয়া উচিৎ যেনো হত্যাকাণ্ডটির সঠিক তদন্ত ও বিচার হয়।
‘বাংলাদেশে চাঞ্চল্যকর অনেক মামলার তদন্তের ফলাফল আমরা জানতে পারি না,’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য দেশেও আমরা অনেক সময়ই দেখি এ ধরণের কেসগুলোতে তদন্ত ও বিচারে বেশি সময় লাগে। অন্তত আমাদের কাছে আপডেট থাকা উচিৎ যে তদন্তটা ঠিকভাবে এগোচ্ছে। কিন্তু সেটিও এক্ষেত্রে নেই।’
মোল্লাহ আমজাদ হোসেন বলেন, ‘সাগর বয়সের দিক থেকে আমার অনেক ছোট হলেও আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলো। ওদের হত্যার বিচার হচ্ছে না, এজন্য প্রতি মুহূর্তেই কষ্ট অনুভব করি। আর বাচ্চাটা তো আছেই। সময়ের অভাবে ঠিকমতো ওর খোঁজটাও নিতে পারি না। অনেক কিছুই করা উচিৎ ছিলো। সরকারকে বার বার তাড়া দেয়া দরকার ছিলো। কিন্তু আমাদের দায়িত্বগুলো আমরা কতোটা করতে পারছি তা নিয়ে আমি নিজেই সন্দিহান। আর সত্যি বলতে, দুঃখ বোধ ছাড়া আর কী-ই বা করা আছে আমাদের? মূল বিষয়টা তো রাষ্ট্রের হাতে।’
সাগর-রুনির বন্ধু সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম বলেন: ‘সাগর ও রুনি দু’জনেই আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। কিন্তু বন্ধু ছাড়াও আমি একজন সাংবাদিক। সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন, তার শুরু থেকেই আমি দেখেছি। সাগর-রুনির পরিবারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে পুলিশকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হয়েছে। আমি এ ঘটনার পরের সব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছেই গিয়েছি। তারা বারবারই বলেছেন নতুন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। ডিবি আর র্যাবও একই কথা বলেছে।’
‘আমাদের কথা হলো, এতোদিনে এ ঘটনার একটা পরিণতি তো পাওয়া যাবে, জানা যাবে কী হয়েছিলো। একটা কিছু তো বোঝা যাবে!’ হতাশা নিয়ে বলেন রোজিনা ইসলাম, ‘কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখে আসছি এই হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে নানা ধরণের তথ্য দেয়া হচ্ছে। আমি মারা গেলে হত্যাটা কেনো হলো সেটা তো বের করতে হবে। সেটা যদি শুনতে খারাপও লাগে তবুও প্রকাশ করতে হবে।’
‘এখন কি মেঘের (সাগর ও রুনির ছেলে) বড় হওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে?’ আক্ষেপ নিয়ে বলেন রোজিনা, ‘বছরের এ সময়টা আমার খুব বেশি খারাপ লাগে। কারণ ওই ঘটনার তিন দিন পরই আমার মেয়ের জন্ম হয়। তাই ওর জন্মদিনটা কাছে এলেই হত্যার ঘটনাটাও বারবার আমার মনে পড়তে থাকে। প্রতিবার মেঘ আমার মেয়ের জন্মদিনে আসে। ওর মুখটা দেখলে আমার বুক ফেটে যায়…।’
মামলাটির অগ্রগতি হচ্ছে না কেনো, এর পেছনে দু’টি কারণ রয়েছে বলে তিনি মনে করেন: ‘এক. আমাদের দেশে বড় কোনো ঘটনা ঘটলেই ব্যক্তিগত বিষয় টেনে এনে আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এখানেও তা-ই ঘটেছে। ঘটনাটিকে নানা দিকে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে হত্যার আসল কারণটা হারিয়ে গেছে অনেক গভীরে। আর দুই. সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে যে আন্দোলন, যে চাপটা আসার কথা ছিলো সেটা নেই। আমাদের বড় বড় সাংবাদিক সংগঠনগুলোর কাজ সাংবাদিকদের বিভিন্ন বিষয়ে নজর দেয়া। কিন্তু আমরা সেটা করছি না। মৃত্যুদিন উপলক্ষে দু’দিন অনুষ্ঠান, লেখালেখি হবে; ব্যাস, এটুকুই।’
অগ্রগতির ব্যাপারে সরকারের একটি আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন রোজিনা ইসলাম।
‘আমি অনেক চেষ্টা করেছি অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঘটনাটি উদঘাটনের। কিন্তু এখনো পারিনি। এটা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু একজন রিপোর্টার, বন্ধু এবং বোন হিসেবে আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবো,’ বলেন রোজিনা।
তিনি বলেন: সাগর-রুনির মতো দুই সাংবাদিকের জোড়া খুনের বিচার না হলে মানুষের মনে গেঁথে যাবে বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় না। তাই সরকারের যতো দ্রুত সম্ভব এর একটা ব্যবস্থা করা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন।
সাগর-রুনির বন্ধু-সহকর্মী সাংবাদিক নাদিরা কিরণ বলেন: বাংলাদেশে সাধারণত: এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কারণটা বের করে ফেলতে পারে। সাগর-রুনির ক্ষেত্রে প্রথমে বেশ নড়চড় দেখা গেলেও পরে কেনো কিছু হলো না, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি। রোজিনা ইসলামের মতো তিনিও বলেন, চুরি-ডাকাতি হোক, বা অন্য কিছু, সেটা এখনো বের হলো না কেনো সেটাই কথা।
নাদিরা বলেন, ‘গোয়েন্দারা বলেন অপরাধীরা সবসময় প্রমাণ রেখে যায়। তাহলে কি আমাদের গোয়েন্দারা সেই প্রমাণটা পাননি? ব্যর্থতাটা কোথায়?’ চার বছর পরও এতো আলোচিত হত্যাকাণ্ডটির ব্যাপারে সাগর-রুনির পরিবার ও পরিচিতরা কিছু জানতে না পারাটা দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নাদিরা দুঃখ করে বলেন, ‘বিশেষ দিনটি আসলেই শুধু সাংবাদিক কর্মীদের পক্ষ থেকে যতোটা কথা আসার আসে। অন্য সময় আলোচনায়ও আসে না। ব্যাপারটা কেমন ফ্রিজ হয়ে গেছে বলে আমার মনে হয়।’
র্যাবও এখন কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছে না বলে ধারণা নাদিরার। বারবার সহায়তার জন্য র্যাবের ডাকে যোগাযোগ করে তদন্তের অগ্রগতির ব্যাপারে কোনো সদুত্তর পাননি বলে জানান তিনি। ‘অগ্রগতি কেনো হচ্ছে না সে প্রশ্ন আমারও।’
সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রথমে তোড়জোড় করে আন্দোলন শুরু হলেও একসময় তাদের মাঝেই ঘটনাটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও বিভেদ দেখা দেয় বলে জানান নাদিরা। তিনি বলেন, সাংবাদিকরা প্রথম প্রথম ঐক্যবদ্ধ হয়ে তদন্তের চেষ্টা চালালেও মূল তদন্তের কাজ ছিলো গোয়েন্দাদের। তারা যদি পুরোপুরি সেটা না করতে পারেন, সাংবাদিকদের পক্ষে সম্পূর্ণ তদন্ত সম্ভব নয়।
নাদিরা মনে করেন, এখনো সাংবাদিক নেতারা এক হয়ে তদন্তের জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে তাগাদা দিলে দ্রুত সঠিক তদন্ত সম্ভব। বিচ্ছিন্ন চেষ্টায় এটা সম্ভব নয়। ‘কিন্তু এটা এখন কতোটা হবে আমি জানি না। আমরা আসলে এখন শুধু ক্ষোভ প্রকাশ করি। সম্মিলিত আন্দোলন করতে পারি না,’ হতাশ স্বরে বলেন তিনি।
তদন্তের স্থবিরতার পেছনে সরকারের চূড়ান্ত গাফিলতিকে দায়ী করেন সাগর-রুনির আরেক বন্ধু রফিকুল বাসার। তিনি বলেন, তদন্ত প্রক্রিয়ায় যেভাবে এগোনো দরকার ছিলো সেভাবে এগোনো হয়নি। তবে সরকারের পাশাপাশি নিজেদের দোষও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, ‘যেভাবে উচিৎ ছিলো সেভাবে আমরা সাংবাদিক বা বন্ধুরা তদন্তকে এগিয়ে নিতে পারিনি, চাপটা অব্যাহত রাখতে পারিনি। সরকারের দিক থেকেও করেনি।’
ময়নাতদন্তে সব তথ্য বেরিয়ে আসবে, গণমাধ্যমের সামনে এ কথা বলার পরও সময়মতো আলামত না পাঠানো, সাগর ও রুনির ফোনকলের রেকর্ড পরীক্ষার কথা বললেও সেখানে দীর্ঘসূত্রিতা – তদন্ত কর্মকর্তাদের এমনই কিছু সমস্যার উদাহরণ দেন বাসার।
রফিকুল বাসার বলেন, ‘তদন্ত সফল করতে যে পথে এগোনো দরকার ছিলো আমরা সেখান থেকে সবাই দূরে সরে গেছি। আমরা প্রথম দু’এক বছর মুখে মুখে খুব কথা বলেছি। আসল কাজ করিনি। আর এখন তো মুখের কথাও বন্ধ করে দিয়েছি।’ তাই এই মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে মোল্লাহ আমজাদ হোসেনের মতো সন্দিহান তিনিও।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে নানা রকম পরস্পর বিরোধী, বিভ্রান্তিকর কারণ ঢোকানো হয়েছে। বাসার মনে করেন, এ কাজটি ইচ্ছাকৃত। এতে ঘটনাটির মধ্যে এতোটা বিভ্রান্তি ও সন্দেহ ঢুকে গেছে যে, সত্যিটা প্রকাশ পেলেও হয়তো এখন আর কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না।
তিনি বলেন, র্যাব বারবার তদন্তের কথা বলে আদালতের কাছ থেকে সময় নিচ্ছে। কিন্তু এখনো কোনো অগ্রগতি হয়েছে কিনা তার কিছুই জানাচ্ছে না। ‘তদন্ত সংস্থার অনেক ব্যর্থতা থাকতে পারে। তারা কোনো কিছু না-ও বের করতে পারে। কিন্তু এটা তো দেখা যেতে হবে তারা চেষ্টা করছে। তেমন কিছু তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে পশ্চিম রাজাবাজারের ফ্ল্যাট থেকে সাগর ও রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। চার দিনের মাথায় মামলাটি হস্তান্তর হয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে।
তদন্তের ৬২ দিনের মাথায় উচ্চ আদালতে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল মামলাটি র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের ৭৬ দিনের মাথায় ওই বছরের ২৬ এপ্রিল আরেক দফা ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে সাগর-রুনির মৃতদেহ তোলা হয়। তারপর থেকে এখনো শুধু কিছু ধারণা আর সন্দেহের ধোঁয়াশাতেই রয়েছে এর তদন্ত প্রক্রিয়া।